দেশের বাস্তবতা বোঝে না আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক
বাংলাদেশের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। কিন্তু এই দেশের বাস্তবতা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বোঝে না। গতকাল শনিবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাত অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডের মতো কাজ করে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, একটা সময় ব্যাংকে রোডম্যাপ ছিল, কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সেগুলো সব চলে গেছে। এখন আবার কেন সেই বিধি-বিধানের কথা বলা হচ্ছে, ঋণখেলাপির সংজ্ঞা আরো আন্তর্জাতিকমানের পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে? রোডম্যাপ যে করা হচ্ছে, সেই রোডম্যাপ দিয়ে আমরা কতদূর আসলাম, কী কারণে সেখান থেকে বিচ্যুত হলাম, কখন হলাম, তার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। তার যৌক্তিক কারণ না বুঝে আবার রোডম্যাপ করলে কোনো কাজে আসবে না।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, সুদহার বেঁধে দেওয়ার বিষয় নিয়ে খুবই আলোচনা হচ্ছিল। এই সুদহার এক জায়গায় বেঁধে দেওয়া হবে কি না, সেটা ৬ বা ৯ শতাংশ হবে ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে নাকি সম্পূর্ণ উদার করে দেওয়া হবে, ঋণ ও আমানতের চাহিদা অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ হবে। এটা একসময় করা হয়েছিল, তখন এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলেছিল, এটা (সুদহার) উদারীকরণ করা হোক। সেই উদারীকরণের পরে নয়-ছয়ে আবারও বেঁধে দেওয়া হলো। অনেক দিন ধরে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, উচিত ছিল তার আগেই ছেড়ে দেওয়া। আবার যখন সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া হলো তখন আগের সব যুক্তি আমরা ভুলে গেছি।
তিনি বলেন, একবারে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে ছোট ছোট ব্যাংকগুলো, যারা নাজুক অবস্থায় আছে, আমানত পায় না, তারা তো গ্রাহককে আমানতের জন্য বেশি সুদহার দিয়ে আকৃষ্ট করতে চাইবে। যারা খুব নিরাপদ ঋণগ্রহীতা না, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতা, তাদের ঋণ দিয়ে আপাতত বেঁচে থাকতে চাইবে। সেখানেও সমস্যা তৈরি হবে। এটার আপাতত একটা সীমা থাকা দরকার। কারণ ঋণের সুদহারে যদি ঊর্ধ্বসীমা না থাকে তাহলে ওই ঋণগ্রহীতারা হয় খুব ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নেবেন অথবা যাঁরা মনে করেন ঋণ নিচ্ছি আর ফেরত দেব না, তাঁদের কাছে তো সুদের হার কোনো বিষয় না। আমাদের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। কিন্তু এই বাস্তবতা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বোঝে না।
নতুন প্রজন্মের ব্যাংক নিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, তিন বছর আগে যে ব্যাংকগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল প্রভাবশালীদের, সেগুলো যে খুব বেশি আমানত সংগ্রহ করতে পারিনি এটা ঠিক। এক হাজার কোটি টাকার আমানতও অনেকে সংগ্রহ করতে পারেনি বা নেই। এভাবে তারা টিকে থাকতে পারবে না। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ওই ব্যাংকগুলোর আমানত আবার একত্র করা হোক বা কমিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এই ব্যাংকগুলোকে যখন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল তখন বহুবার আমরা বলেছি, বাংলাদেশের মার্কেটে এত বেশি জায়গা নেই। এটা এত দিন পর বুঝতে পারল কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, দেশে অনেক দুর্বল ব্যাংক আছে, সেগুলোকে একত্র করা যায় কি না দেখতে হবে।
ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু নিয়ম-কানুন দরকার, সেই নিয়মের কথা চিন্তা করিনি। সে জন্য তারা (বেসরকারি ব্যাংক শেয়ারধারী) বলেছিল, ব্যাংক দিয়েছি টাকা নেওয়ার জন্য। সেই ভুল আবারও যেন না করি।
অবলোপন করা ঋণখেলাপি হিসেবে প্রকাশ করা হয় না : সালেহউদ্দিন
অনুষ্ঠানে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিবছর খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণের বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের খেলাপি ঋণকে রাইট অফ বা ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। অবলোপন করা ঋণ ব্যালেন্স শিটের অন্তর্ভুক্ত থাকে না বিধায় তা খেলাপি ঋণ হিসেবেও প্রকাশ করা হয় না।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রিসিডিউল করেছে, এখানেও সে ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। আমদানি-রপ্তানি নিয়েও তথ্যবিভ্রাট রয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মধ্যে। সবদিক বিবেচনায় দেশের ব্যাংকিং খাত এখন ‘উল্টো রথে’। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে খেলাপি হলে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতায় মারা যান। ঋণখেলাপি বাড়িভাড়া নিতে পারেন না, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না, সামাজিকভাবেও নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। আমাদের এখানে ঋণখেলাপি মহানন্দে থাকেন।
নতুন ব্যাংক নিয়ে তিনি বলেন, একটা ব্যাংক খোলা হবে আর শহরে কিছু শাখা দিয়ে চলবে—এটা দরকার নেই। তাদের প্রান্তিক পর্যায়ে শাখা খুলতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংক খোলার সিদ্ধান্ত আসে রাজনৈতিকভাবে। এতে ব্যাংকে খেলাপি বাড়ছে।