সিংগাইর-হরিরামপুরে মমতাজের হুকুমই ছিল ‘আইন’

বিনোদন ডেস্ক ঃ

 

একসময় পথে প্রান্তরে মাজারে মাজারে ঘুরে বাবা মধু বয়াতির সঙ্গে গান গাইতেন। আর্থিক টানাপোড়নের মধ্যে যেত দিনকাল। ইত্যাদিতে গান গেয়ে লাইমলাইটে আসেন। এরপর দ্বিতীয় স্বামী রমজানের হাত ধরে নাম লেখান রাজনীতিতে।

২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই একসময় অর্থকষ্টে অনাহারে থাকা সংগীতশিল্পী মমতাজের ভেতরে চলে আসে দাম্ভিকতা। গত ১৬ বছর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।
নিজ গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। শুধু তাই নয়, কানাডাতেও তার রয়েছে বাড়ি-গাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দুর্নীতি ও নানা অনিয়মে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া মমতাজের বর্তমান ঠিকানা কারাগার। 

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পর ৯ মাস ধরে আত্মগোপনে ছিলেন মমতাজ।

গত ১২ মে রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও মানিকগঞ্জে ৬টি মামলা রয়েছে।

মমতাজ মানিকগঞ্জ-২ আসনের এমপি ছিলেন। নিজের নির্বাচন এলাকা সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলা চলতো তার ইশারায়। এই দুই উপজেলায় মমতাজের হুকুমই ছিল আইন।

আধিপত্য বিস্তার করতে নিজের নির্বাচনী এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দখলবাজি, চাকরি বাণিজ্য নিজের বাহিনী দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন মমতাজ। কেউ তার কথা বা হুকুমের বাইরে গেলে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হতো। শুধু তাই নয়, পুলিশ প্রশাসনও ছিল মমতাতের হাতের মুঠোয়। এ ছাড়া তার নানা অপকর্মের মধ্যে ‘বিয়ে করা’ ছিল অন্যতম। এ পর্যন্ত কাগজে-কলমে তিনটি বিয়ে করেন মমতাজ। যদিও কোনো স্বামীর সঙ্গে তার সংসার টেকেনি। নিজের এপিএস জুয়েলের সঙ্গেও তার গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পথচলা শুরু পর থেকে চমক দেখান হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মমতাজ। টানা ১৬ বছর নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজন নিয়ে সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলা শাসন-শোষণ করেছেন তিনি। তার কথায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও উঠতেন-বসতেন। কথার বাইরে গেলে দলীয় পদ বঞ্চিত করা হতো নেতাকর্মীদের। মমতাজের অপকর্মের প্রধান সঙ্গী ছিলেন সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শহীদ। মমতাজের প্রথম স্বামী রশিদ সরকারের আপন ভাগ্নে এই শহীদ। মমতাজ নিজেই সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ দখলের পাশাপাশি তার কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করেছেন শহীদুর রহমান শহীদকে। এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। শহীদই ছিল মমতাজের সব অপকর্মের প্রধান খলিফা। নিজের হেলমেট বাহিনী দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, মমতাজ তার সৎ ছেলে আবু নাঈম বাশারকে ভোটর চুরির মাধ্যমে সিংগাইর পৌরসভার মেয়র বানিয়েছিলেন। উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মমতাজের ছোট মেয়ে রাইসা রোজ ও নিজ ইউনিয়ন জয়মন্ডপ ছাত্রলীগের সভাপতি তার বড় ভাই এমারত হোসেনের ছেলে ফিরোজ কবির। তার এক সৎ বোন ইউপি সদস্য। শুধু তাই নয়, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের প্রত্যেকটা কমিটিতে মমতাজের আত্মীয়-স্বজন এবং নিজস্ব লোকজন দিয়ে গঠন করা হয়। সেখানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ভর করেই হরিরামপুর শাসন করতেন মমতাজ। টেন্ডার, চাঁদাবাজি, লুটপাট, পদ্মায় বালু দখল, সরকারি অফিসগুলোতে কমিশন বাণিজ্যসহ সব ধরনের অপকর্মের অন্যতম ছিলেন মমতাজের প্রধান খলিফা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি লুৎফর রহমান ও তার বাহিনী। তবে মমতাজের প্রধান শত্রু ছিল হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে এই দু’জনের মধ্যে সবসময়ই ঝামেলা লেগেই থাকতো।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সিংগাইরে মাত্র ৪৮ শতাংশ পৈত্রিক জমি ছিল মমতাজের। এমপি হওয়ার পর হাতে পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। এরপরই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মালিক বনে যান হাজার কোটি টাকা।

মমতাজের নিজ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিংগাইরে ১৩শ শতাংশ জমির ওপর মমতাজ গড়ে তোলেন বিরাট বাংলো বাড়ি। সিংগাইর- হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে মধুর আড্ডা নামে একটি রেস্টুরেন্ট ও বৈঠকখানা বানিয়েছেন। ১৩ একর জমির মধ্যে মধু ও উজালা কোল্ড স্টোরেজ, মধুমেলা, দোতলা বাড়ি, বাউল কমপ্লেক্স, চারতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেন। এগুলো ছাড়াও ঢাকা ও কানাডায় গাড়ি-বাড়িসহ নানা স্থাপনা গড়েছেন মমতাজ।

এ বিভাগের অন্যান্য