তাঁর অন্তিম শয্যার পাশে ছিল ‘মেছোবাঘের ছানা’
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি ::
প্রায় এক দশক ধরে এরা একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে মমতার নিবিড় বন্ধনে বাঁধা পড়ে ছিল। ‘তানিয়া খান’ আর ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী’ এ দুটি শব্দ যেন অবিচ্ছেদ্য। নিজের জীবন ও সম্পদের পাশাপাশি স্বামী এবং পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সব সম্পদ দিয়ে আজীবন অসুস্থ বন্যপ্রাণীর সেবা করে যাওয়া ‘বন্যপ্রাণীদের মা’ খ্যাত তানিয়া খান (৪৮)। (ইন্না…….রাজিউন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরিতে যোগ দেননি তিনি। আজীবন বন্যপ্রাণীর সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় মৌলভীবাজারের কালেঙ্গা এলাকায় নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তানিয়া খান।
তানিয়া খানের সেবা পেয়ে গত দেড় দশকে ৩০-৩৫ প্রজাতির পাঁচ হাজারের অধিক পাখি এবং ৮-৯ প্রজাতির চার শতাধিক বন্যপ্রাণী প্রাণ ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি মুক্ত হয়ে ফিরে গেছে নীড়ে।
নিজের জমানো টাকার পাশাপাশি স্বামী এবং বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সব সম্পদ তিনি খরচ করে গেছেন বন্যপ্রাণীর সেবায়। দীর্ঘদিন মৌলভীবাজার শহরতলীর সোনাপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ভাড়া বাসায় বন্যপ্রাণীদের সেবা দিতে সমস্যা হওয়ায় বাবার থেকে পাওয়া ঢাকার একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেন তিনি। পরে মৌলভীবাজার শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ কালেঙ্গায় জায়গা কিনেন তিনি। সেখানে বন্যপ্রাণীদের সেবার জন্য গড়ে তুলেছেন ‘সেভ আওয়ার আনপ্রোটেক্টেড লাইফ (সোল)’। যার মাধ্যমে একটি রেসকিউ সেন্টার চালু করে হাজারো বন্যপ্রাণীকে সেবা দিয়ে গেছেন তিনি।
জীবিত থাকা অবস্থায় কথা হয় তানিয়া খানের সাথে। তিনি বলেছিলেন- ‘পশুদের প্রতি ভালোবাসা ছিল আমার ছোটবেলা থেকেই, তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। বাবা মো. ওয়াজেদুল ইসলাম বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই অসুস্থ কুকুর-বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে আসতেন। অসুস্থ বন্যপ্রাণীকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব আমাকে দিতেন বাবা। ওই বয়সে মায়ের মতো পরম মমতায় কোলে করে প্রাণীদের সুস্থ করে আবার মুক্ত করে দিতাম। সেই থেকে বন্যপ্রাণীদের প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা শুরু হয়।
স্বামীর বাড়ি সুনামগঞ্জে হলেও ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার একেএম মুনির আহমেদ খানের চাকরিস্থল মৌলভীবাজার হওয়ায় ২০০৯ সাল থেকে সেখানেই বসবাস শুরু করেন তারা। স্থানীয় বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক ও লাউয়াছড়া এবং হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মতো বিশাল এলাকায় শুরু হয় তানিয়ার বিচরণ।
২০১৫ সালে স্বামী মারা গেলে বন্যপ্রাণীর প্রেমে মৌলভীবাজারে থেকে যান তানিয়া। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার সুবিধার্থে ঢাকায় থাকেন। ছেলে-মেয়েরা বার বার তানিয়া খানকে নিয়ে যেতে চাইলেও যাননি। তানিয়ার যুক্তি ছিল আমার ছেলে-মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে নিজেরাই চলতে পারবে। কিন্তু বনেজঙ্গলে থাকা হাজার হাজার বন্যপ্রাণীর কি হবে। বন্যপ্রাণীরাও আমার সন্তান, আমি তাদের রেখে যেতে পারি না। মৃত্যুর সময়ও তানিয়ার কাছে একটি মেছো বাঘের বাচ্চা, ৭-৮টি কুকুর এবং প্রায় ১০০টির মতো পাখি ছিল। যাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
২০১২ সালের পর থেকে দেশে বন্যপ্রাণীর তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করেন তানিয়া খান। বন্যপ্রাণীর সেবার পাশাপাশি তিনি অনেক নতুুন নতুন প্রাণী আবিষ্কার করে গেছেন।
২০১৪ সালে হবিগঞ্জের সাতছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে খুঁজে পান থ্রি স্টামস বাংকিং নামের একটি পাখি। এই পাখি দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় এবং দেশে প্রথম দেখার রেকর্ড হয়। ২০১৩ সালে সাতছড়িতে হিল ব্লু-ফ্লাই ক্যাচার খুজে পান। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ‘পাইড ওয়ার্টি ফ্রগ’ নামের একটি ক্ষুদ্র ব্যাঙ আবিষ্কার করেন ২০১২ সালে। এছাড়া ‘বুশ ফ্রগ’ জাতের আরও একটি ব্যাঙের দেখাও পেয়েছেন তিনি।
২০১২ সালে প্রথম এবং ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মৃত ‘চিকিলা ফুলেরি’ নামের একটি প্রাণী আবিষ্কার করেন তানিয়া খান। এটি একটি বিরল প্রাণী। মৌলভীবাজারের আদমপুরে ‘ফলস কোবরা’ নামের একটি সাপ এবং লাউয়াছড়ায় ‘হিমালয়ান মোল’ নামের এক প্রাণী আবিষ্কার করেন। এ দুটি প্রাণীও দেশে প্রথম দেখার রেকর্ড তানিয়ারই। এ পর্যন্ত যৌথভাবে প্রজাপতি, বামন মাছরাঙা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তার বেশ কয়েকটি নিবন্ধন প্রকাশিত হয়েছে।
তানিয়া খানের তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় দুই মেয়ে নিজেদের সংসার ও চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। ছোট মেয়ে এবং একমাত্র ছেলে সুনামগঞ্জে শাশুড়ির কাছে থেকে ঢাকায় লেখাপড়া করেন। মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে আসতেন তারা।
তানিয়া খান জীবিত থাকা অবস্থায় জানিয়েছেন, বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। স্থানীয় বনবিভাগ এত কম জনবল নিয়েও যেভাবে মৌলভীবাজারের বিশাল এলাকায় কাজ করছে এবং আমাকে সহযোগিতা করেছে তার জন্য কৃতজ্ঞ।
তানিয়া খানের মৃত্যু কিছুদিন আগে স্থানীয় বেসরকারি একটি হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তি ছিলেন। তখন তিনি বলেছেন- ‘আমার কিছু হলে তা নিয়ে কাউ ভাবতে হবে না। যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা যদি বন্যপ্রাণীর নিরাপদ জীবনের জন্য আমার প্রতিষ্ঠিত সেভ আওয়ার আনপ্রোটেক্টেড লাইফ (সোল) নিয়ে কাজ করেন তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।’
তানিয়া খানের মৃত্যুতে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে জড়িত এবং প্রাণীপ্রেমীদের মধ্যে শোকের মাতম চলছে। একনজর তাকে দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই ছুটে এসেছেন।
তানিয়া খান নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ মনিরুল এইচ খান বলেন, আমরা যারা বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করি তাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন তানিয়া খান। তার মৃত্যু প্রাণীজগতের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেলো। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের প্রাণীদের। তানিয়া খান যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে বন্যপ্রাণীদের নিয়ে কাজ করেছেন এবং মাতৃ¯েœহে প্রাণীদের সেবা দিয়ে বাঁচিয়েছেন তা কল্পনাতীত।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক ও সাবেক সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো জানান- ‘বন্যপ্রাণীর সেবায় অনেকেই কাজ করছেন। কিন্তু আমার জীবনে তানিয়ার মতো এত আন্তরিক কাউকে দেখিনি। মা যেমন নিজের সবকিছু উজাড় করে সন্তানের জীবন রক্ষা করেন, বন্যপ্রাণীদের নিজ সন্তান ভেবে তাই করতেন তানিয়া।’