এনামুল হাবিবেব ‘কাজে’ আরিফের ‘বাহাদুরী’

সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘিরে শুরু হয়েছে উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা। গত পাঁচ বছরে মহানগরীতে বিপুল উন্নয়ন করেছেন বলে দাবি সদ্য সাবেক মেয়র ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর। তবে এমন দাবি কোনোই যৌক্তিকতা মেলানো যাচ্ছে না। কারণ দায়িত্ব গ্রহণের বছর খানেক পরই আরিফকে যেতে হয় কারাগারে। তিনি কারাবরণ করেন প্রায় আড়াই বছর। কারাগারে থেকে কীভাবে এতো উন্নয়নের পরিকল্পনা এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন-তা নিয়ে ওঠেছে প্রশ্ন।

জানা গেছে, আরিফুল হক চৌধুরী কারাগারে যাওয়ার পরই সিলেট সিটি কর্পোরেশরে ভারপ্রাপ্ত মেয়র পদ নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। নানা জটিলতার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সিটি কর্পোরেশনকে সচল রাখতে প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব দেয় কর্পোরেশনের তৎকালিন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীবকে। আরিফ যতদিন করাগারে ছিলেন ততদিন দায়িত্বে ছিলেন এনামুল। আর তখনই তিনি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তৈরি করেন একাধিক প্রকল্প। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু হয় মহানগরীর উন্নয়ন।

এনামুল হাবীব অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি আবুল মাল আবদুল মুহিতের সহযোগিতায় এক এক করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দেন। এনামুল হাবীব দায়িত্বরত অবস্থায়ই পরবর্তী সময়ের সকল কাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তৈরি ছিলো। ওই সময় যেসকল কাজ বাস্তবায়িত হয় তার অধিকাংশই উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী। এরপর প্রায় আড়াই বছর পরে কারামুক্ত হন আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বেরিয়ে এনামুলের কারানো বেশ কয়েকটি কাজের উদ্বোধনও করেন।

তবে সিটি কর্পোরেশন এলাকার উন্নয়নে ব্যয় হওয়া টাকার মধ্যে হাজার কোটি টাকাই বরাদ্দ সরকার। আর উন্নয়নের সিংহভাগই হয়েছে সিলেট-১ আসনের এমপি ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাত ধরে। কিন্তু বর্তমানে আরিফের জোরালো নির্বাচনী প্রচারণায় আড়ালে পরে গেছে উন্নয়ন কারিগর মুহিতের নাম।

অবশ্য আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলছেন, আরিফ দায়িত্বে থাকতে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা তারই সময় করা মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। তিনি বলেন, একজন জনপ্রতিনিধি দীর্ঘসময় কারাগারে থেকে কীভাবে এতো উন্নয়ন করবেন। এই নগরের মানুষ তা খুব ভালো করেই জানেন। সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার সকল উন্নয়নই করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।

সূত্র মতে, তখন ২০১৩ সালে বিপুল ভোটে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। এই নির্বাচন ছিলো সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তৃতীয় নির্বাচন। আরিফ মেয়রের দায়িত্ব পেয়েই গুরুত্ব দেন ছড়া-খাল উদ্ধারে। একেরপর এক অভিযানও দেন তিনি। বছর খানেক সময় যেতে না যেতেই সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে ঘিরে ধরে দুঃসময়। বিপদ এসে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে তাকে। অবশেষে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা মামলায় কারাগারেই ঠাঁই হয় তার। এরপরই সিসিকে শুরু হয় প্যানেল মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে জটিলতা। স্থানীয় সরকার আইনকে তোয়াক্কা না করে প্যানেল মেয়র (১) রেজাউল হাসান কয়েস লোদীকে দায়িত্ব দেননি আরিফ। দায়িত্ব দেন প্যানেল মেয়র (২) সালেহ আহমদ চৌধুরী। এমন সিদ্ধান্তে কয়েস লোদী হাইকোর্টে রিট করেন। জটিলতায় স্থবির হয়ে পড়ে সিটি কর্পোরেশন।

সিটি কর্পোরেশনকে সচল করতে মন্ত্রনালয় থেকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয় তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীবকে। এনামুল হাবীব দায়িত্ব পেয়েই নগরীর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অর্থমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে ধারাবাহিক কাজ শুরু করেন। এনামুল হাবীব আড়াই বছরের উপরে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময়কার করানো কাজের বেশ কয়েকটি নাম ফলক অর্থমন্ত্রীর নামেও লাগানো হয়।

এরপর আড়াই বছরের উপরেও কারাবরণ করে দায়িত্ব নেন আরিফ। দায়িত্ব নিয়ে তিনি বেশ কিছু উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর প্রায় আড়াইটি বছরই অর্থমন্ত্রীর নাম আড়ালে পড়ে যায়। উন্নয়নকাজ আরিফের করা এমন তথ্য নগরবাসী জানলেও আরিফ সিসিকের শেষ বাজেটে অর্থমন্ত্রীর সহযোগিতার কথা স্বীকার করেই লিখিত বাজেট প্রকাশ করেছিলেন।

এদিকে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। তখন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) মেয়র ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। সেসময় নগরীর ছড়া উদ্ধারের জন্য সরকার থেকে সিটি কর্পোরেশনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মাত্র ১১ কোটি টাকা। আর বর্তমানে এই একই সরকার ক্ষমতায় এবং বিএনপির মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তার আমলে সিলেট নগরীর উন্নয়ন ও ছড়া-খাল উদ্ধারে সিটি কর্পোরেশনকে অর্থ মন্ত্রনালয় বরাদ্দ দেয় ৮শ কোটি টাকা।

বিএনপি নেতার আমলে এই বিশাল অংকের টাকা বরাদ্দে বর্তমান সরকার প্রতিহিংসাপরায়ন নয়; বলেই মনে করেন সচেতন মহল। আর দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখে সাধারণ মানুষ বলছে, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগরীর উন্নয়ন কাজ করিয়েছেন। তবে সরকার থেকে যে এতো পরিমাণ টাকা দেয়া হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগই এর উন্নয়নের ধারক-বাহক সে মেসেজটি তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছেনি। এরফলে শ’ শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ায় এর পুরো সফলতা নিচ্ছেন বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। তবে তার দাবি, এতো টাকা বরাদ্দ হলেও তার হাত দিয়ে তা ব্যয় হয়নি।

শুধু তাই নয়; বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন সিসিকের মেয়র। সেসময় মহানগর বিএনপির সভাপতি বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ছিলেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তখন প্রয়াত এম. সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকায় আরিফুল হক চৌধুরীর ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। সাইফুর রহমান তাকে খুব বিশ্বাস করতেন এবং তার কথা শুনতেন। আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ভেবেছিলেন আরিফকে নগর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি করলে তিনি নগরীর উন্নয়নে সাইফুর রহমানের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনে বরাদ্দ আনবেন।

কিন্তু অভিযোগ ছিল, সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে কোনো টাকা বরাদ্দের সুযোগ দেননি আরিফুল হক চৌধুরী। তবে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রচেষ্টায় নগরীর উন্নয়নে টাকা বরাদ্দ অব্যাহত ছিলো।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান হিসবারক্ষণ কর্মকর্তা আ.ন.ম মনসুফ বলেন, নগরীর উন্নয়নে বর্তমান সরকার মোট ৭৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এরমধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ এখনো কোষাগারে জমা হয়নি। তবে পূর্বের বরাদ্দকৃত ২৫০ কোটি টাকা জমা হওয়ার পর তা দিয়ে চলছে দৃশ্যমান উন্নয়ন। উল্লিখিত টাকার মধ্যে ১৩৭ কোটি টাকা অবকাঠামো উন্নয়ন, ১শ কোটি টাকা ছড়া-খাল উদ্ধারে ব্যয় ও ১৩ কোটি টাকা ট্রাক টার্মিনালের জন্য ব্যয় ধরা হয়।

এছাড়া নতুন বরাদ্দে ছড়া-খাল উদ্ধারে আরো ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দের ফলে এ খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটি টাকা।

এ বিভাগের অন্যান্য