সিলেট খুনের মিছিল বাড়ছে চরমভাবে

সিলেটের সময় ডেস্ক:

হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠছে সিলেট। খুন খারাবি বেড়ে গেছে চরমভাবে। চলছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল। আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটে চলতি বছরের গত তিন মাসে ছেলের হাতে মা খুন, মা কর্তৃক সন্তান খুন, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, ভুরিভুজের টাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খুন, প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ধর্মীয় বিতর্কে খুন রাহাজানি, শিশুর সামনে মা ও ভাইকে খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টাসহ অন্তত অর্ধশত ঘটনা ঘটেছে, যা কেবল সিলেট নয় পুরো দেশের মানুষের কোমল হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মিডিয়ায় বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছে সিলেট। সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে নানাজন নানা মত দিচ্ছেন। খুন দিয়ে শুরু হওয়া চলতি বছরের সিলেটে আলোচিত কয়েকটি ঘটনা নি¤œরূপ ॥
বোনের সামনে মা ও ভাই খুন ॥ সিলেট নগরীর মীরাবাজারের খাঁরপাড়ার মিতালী আবাসিক এলাকার ১৫/ জে বাসা থেকে রোকেয়া বেগম (৪০) ও তার ছেলে রবিউল ইসলাম রুকন (১৬) এর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় ওই বাসা থেকেই জীবিত উদ্ধার করা হয় পাঁচ বছরের শিশু রাইসাকে। গত পহেলা এপ্রিল দুপুরে তাদের উদ্ধার করা হয়। নিহত রুকন মীরাবাজার শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলো। রোকেয়া জড়িত ছিলেন পার্লার ব্যবসার সাথে। দুর্র্বৃত্তরা রোকেয়াকে গলা কেটে এবং রুকনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে মেয়ে রাইসাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। পুলিশ বলছে, রাইসার গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঠিক কি কারণে নিজের শয়ন কক্ষে নৃশংসভাবে খুন হলেন মা ও ছেলে এখনও সবার কাছে অজানা । তবে শিশু রাইসা জানিয়েছে, কাজের মেয়ে তানিয়া তার ভাই ও মাকে হত্যা করেছে। পুলিশ সেই সূত্র ধরেই তদন্তে এগুচ্ছে। তবে ছোট্ট রাইসার সামনে মা ও ভাইকে হত্যার মতো ঘটনা নাড়া দিয়েছে সবাইকে।
ভুরিভোজের টাকার জন্য ছাত্র খুনঃ চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে নগরীর মদীনা মার্কেট এলাকার বাসা থেকে বের হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মাহিদ আল সালাম। রাত তখন ১ টা। ক্বীনব্রিজ থেকে রিকশায় চড়ে কদমতলীর দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। হোটেল হানিফের সামনে পৌঁছামাত্র ৪ ছিনতাইকারী দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে রিকশার গতিরোধ করে। এক পর্যায়ে মাহিদকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় তারা। আহত অবস্থায় মাহিদ আল সালামকে ওসমানী হাসপাতালে নেয়ার পর অধিক রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। এই ঘটনাটি ২৫ মার্চ রোববার রাতের। ঘটনার পর আতিক, রিপন, সাকিল ও রাসেল নামের ৪ ছিনতাইকারীকে আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ। এরপর আতিক মির্জা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তারা জানায়, দুটি মোটরসাইকেলে শহর থেকে বাসায় ফিরছিল চার বন্ধু। হঠাৎ হোটেলে খাওয়ার ইচ্ছা জাগে তাদের। প্রয়োজন হয় টাকার। এরপরই ছিনতাইর পরিকল্পনা করে তারা। রিকশাযাত্রী মাহিদ তখন মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ দিতে চাচ্ছিল না। পরে তারা মাহিদকে ছুরিকাঘাত করে। ছিনতাইকারীরা সামান্য ভুরিভোজের টাকার জন্য এভাবেই কেড়ে নেয় একটি মেধাবীর প্রাণ।
হাওরে মা ও মেয়ের লাশ ॥ ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের একরাই গ্রামের পূর্বের হাওর থেকে নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয় গত ২৪ মার্চ দুপুরে। একারাই গ্রামের পূর্বের হাওর থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হওয়ার বিষয়টি একারাই এলাকার লোকজন পুলিশকে জানায়। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে একটি গলিত লাশ উদ্ধার করে। এ সময় পাশেই ৭-৮ বছরের একটি শিশুর মাথা, পা ও হাতের খন্ড খন্ড অংশ পাওয়া যায়। ওসমানীনগর থানার ওসি শহিদুল্লাহ জানান, লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশ গলে গেছে। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। তবে, হতভাগা এই মা ও শিশুর এখনো পরিচয় মেলেনি।
সালিশে গুলি ও দুই লাশঃ গোয়াইনঘাট উপজেলার বহর ও মিত্রিমহল দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সালিশ চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল মসজিদের জমি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তি। সালিশ চলাকালেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে দুইপক্ষ। শুরু হয় সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে হয় বন্দুকের ব্যবহার। গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জন নিহত। গত ২৪ মার্চ ঘটনাটি ঘটে। মিত্রিমহল গ্রামের আবদুল জলিলের ছেলে মনাই মিয়া (২৬) ও আজিজুল ইসলামের ছেলে রুমেল আহমদ (২৮) সেদিন নিহত হন। ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বহর গ্রামের সহ¯্রাধিক পুরুষ। অন্যদিকে কান্না চলছে নিহতদের পরিবারে। সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনাকে কন্দ্র করে ডাবল মার্ডারের নজির এটি। অবশ্য পুলিশ জড়িতদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। এ ঘটনায় ৯৮ জনের বিরুদ্ধে গোয়াইনঘাট থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে দুটি একনলা বন্দুকও।
বরইকান্দিতে আরো দুই লাশঃ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি গ্রামে দুপক্ষের সংঘর্ষে ডাবল মার্ডারের ঘটনা ঘটে। গত ১৬ মার্চ বরইকান্দি এলাকায় সুমন মিলের সামনে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক যুবক আহত হওয়ার জের ধরে ঘটনাটি ঘটে। বরইকান্দির ৩ নম্বর রোড ও ১০ নম্বর রোডের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষের শুরু হয়। সংঘর্ষে নিহত হন বরইকান্দির ৩ নম্বর রোডের শফিক মিয়ার ছেলে বাবুল মিয়া (৩৫) ও জমসেদ মিয়ার ছেলে মাসুক মিয়া (৪৫)। বরইকান্দির ১০ নম্বর রোডের আলফু মিয়া এবং তিন নম্বর রোডের গৌছ মিয়ার লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে আলফু মিয়ার লোকজনের গুলিতে হত্যাকান্ড দুটি ঘটে। ঘটনার পর থেকে এখনো একটি পক্ষ এলাকা ছাড়া।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা ॥ বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ছিল বিশ্বব্যাপী তোলপাড় করা একটি ঘটনা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ছুরি হাতে তাকে হত্যার চেষ্টা করে ফয়জুল নামের এক তরুণ। ৩ মার্চ ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। সেখানে চিকিৎসা শেষে সিলেটে ফিরেন জনপ্রিয় এ লেখক। এ ঘটনায় হামলাকারী ফয়জুল হাসান, তার বাবা হাফিজ আতিকুল ইসলাম, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুর রহমান, ভাই এনামুল হাসান ও বন্ধু সোহাগ মিয়া কারাগারে রয়েছেন। এঘটনা কেবল সিলেট নয় পুরো দেশ ও বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। জনপ্রিয় এই শিক্ষকের উপর হামলার নিন্দা এখনো চলছে।
ধর্মীয় বিতর্ক ও খুন লুটপাটঃ জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর এলাকাবাসী ও পীরভক্তদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ যায় হরিপুর মাদ্রাসার ছাত্র মৌলভী মুজম্মিল আলীর। গত ২৫ ফেব্রুয়ারী জৈন্তাপুরের হরিপুর, দরবস্তের কওমি মাদরাসাসহ কয়েকটি মাদরাসার ছাত্র ও সীমান্তবর্তী কেন্দ্রী কাঠালবাড়ি, আমবাড়ি ও ঝিঙ্গাবাড়ি এলাকার মানুষের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। তবে ঘটনা কেবল সংঘর্ষে থেমে থাকেনি। মাদরাসা ছাত্র নিহত হওয়ার পর গভীর রাতে কাঠালবাড়ি, আমবাড়ি ও ঝিঙ্গাবাড়ি গ্রামে ব্যাপক লুটপাট করা হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। নারী- শিশুরা সেদিন এক বিভীষিকাময় রাত পার করে। পরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুড়িয়ে দেয়া ৪০টি পরিবারকে চিহ্নিত করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। এখনো একটি পক্ষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রাম ছেড়ে।
বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন ॥ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে নগরীর সুবিদবাজারের নুরানী আবাসিক এলাকার দস্তিদারদীঘি এলাকায় বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় শিমুল দেব (৩২) নামের একজনকে। নিহত শিমুল দেব সুবিদবাজার মিয়া ফাজিল চিস্ত এলাকার সমরেশ দেবের ছেলে। এ ঘটনায় শিমুলের এক বন্ধুকে আটক করা হয়।
স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন ঃ কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের সোনাতনপুঞ্জি গ্রামে স্বামীর হাতে খুন হন জাহানারা বেগম (১৯)। গত ১৮ ফ্রেব্রুয়ারী এ ঘটনাটি ঘটে। স্বামী রিক্সা চালক ইব্রাহীম আলী ইমন কুপিয়ে খুন করে স্ত্রী জাহানারা বেগমকে। অভিযোগ বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি ছড়ায় তার দেবর সিরাজ উদ্দিনের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় আলাপ করছিলেন জাহানারা। এতে স্বামী ইমন ক্ষুব্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে কানাইঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অবশ্য ঘাতক ইমনকে গ্রেফতার করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বামীর হাতেই প্রাণ দিতে হয় হতভাগী জাহানারাকে।
পানিতে চুবিয়ে দুই শিশু হত্যাঃ বিশ্বনাথে তিন বছর বয়সী নাহিদুল ইসলাম মারুয়ান ও ১৮ মাস বয়সী ওয়াহিদুল ইসলাম রুমানকে বালতির পানিতে চুবিয়ে হত্যা করা হয়। আর এই অভিযোগ উঠে মায়ের বিরুদ্ধে। গত ৬ ফেব্রুয়ারী ঘটনাটি ঘটে। নিহতরা কৃষক কবির আলী ও রনি বেগম ওরফে বিউটি আক্তার রনি দম্পতির সন্তান তারা। উপজেলার লামাকাজী ইউনিয়নের কোনাউড়া-নোয়াগাঁও গ্রামে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে। ছেলেদের হত্যা করার পর মা রনি ডেটল সেবন করে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন। অবশ্য এই মা এখনো বেঁচে আছেন।
সিলেটে ছেলের হাতে মা খুন ॥ বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাইয়ের কামারগ্রামে ছেলের হাতে মা খুন হন। গত ৩১ জানুয়ারী এ নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরে কামাল হোসেন (৩০)। সেই মাকে খুনের ঘটনা ঘটায়।
নিহত ছয়মুন বিবির (৫৫) দ্বিতীয় ছেলে কামাল হোসেন। দেশে আসার পর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মায়ের সাথে তার ঝগড়া হচ্ছিল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে ছয়মুন বিবিকে মারধর শুরু করেন কামাল হোসেন। ছয়মুন বিবি ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলে আঙিনায় তাকে ঝাপটে ধরে গলায় ছুরিকাঘাত করেন কামাল। এতে ঘটনাস্থলেই ছয়মুন বিবি মারা যান। অবশ্য ঘাতক পুত্রকে তখন জনতা ধরে পুলিশে দেয়।
স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন ॥ বিশ্বনাথে ডেগার দিয়ে গলা কেটে স্ত্রীকে হত্যা করেছেন স্বামী। নিহতের নাম লুবনা বেগম (২৮)। ২৫ জানুয়ারি বিকেলে উপজেলার সদর ইউনিয়নের জানাইয়া গ্রামে ঘটনাটি ঘটে। স্ত্রীকে হত্যার পর ডেগার হাতে নিয়ে পালিয়ে যায় ঘাতক স্বামী হেলাল মিয়া। সে জানাইয়া গ্রামের মৃত হাজী জহুর আলীর পুত্র ও বিশ্বনাথ সদর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক আহবায়ক। অবস্থায় আহত লুবনা বেগমকে চিকিৎসার জন্য ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। লুবনা বেগম দুই সন্তানের মা ছিলেন। পরে অবশ্য ঘাতক স্বামীকে আটক করতে সক্ষম হয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রেমিকাকে হত্যা করে নিজের আত্মহত্যা ॥ নগরীর সোবহানীঘাট পয়েন্টের আবাসিক ‘হোটেল মেহেরপুর’ থেকে তরুণ-তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয় গত ২২ জানুয়ারী। মিন্টু দেব ও রাখি পাল নামের ঐ তরুণ-তরুণী মুসলিম দম্পতি পরিচয়ে হোটেলের ২০৬ নম্বর রুমে উঠে। মিন্টুর বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে এবং রাখির বাড়ি জৈন্তাপুরে। মিন্টু দেব ও রাখি পাল দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। রাখি পালের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে যাওয়ার পর শেষ বারের মত দেখা করতে সিলেট আসে দুজন। এরপর হোটেলে উঠে। সেই হোটেলেই দুজনের লাশ পাওয়া যায়। তখন পুলিশ জানায়, আলামত দেখে বুঝা যায় মিন্টু প্রথমে রাখিকে হত্যা করে। এরপর নিজে আত্মহত্যা করে।
দুটি রাজনৈতিক খুন ॥ ২০১৮ সালের প্রথম দিনেই সিলেটে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে ছুরিকাঘাতে খুন হন ছাত্রদল নেতা আবুল হাসনাত শিমু (৩০)। নিজ দলের ক্যাডারদের হাতে খুন হন তিনি। শিমু নগরীর আরামবাগের ২ নং রোডের ২২ নং বাসার বাসিন্দা ছিলেন। তার একটি মেয়েও রয়েছে।
অন্যদিকে,৭ জানুয়ারী টিলাগড়ে ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খান। তিনি এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তার বাড়ি ওসমানীনগরে। নিজ দলের ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে খুন হন তানিম। এছাড়া, ২৩ ফেব্রুয়ারী পারিবারিক বিরোধের জেরে খুন হন আলম হোসেন নামের এক যুবক। ১ মার্চ বিশ্বনাথে বিষু নামের এক সিএনজি অটোরিক্সা চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ১৬ মার্চ একই উপজেলায় সংঘর্ষে আরো এক ব্যক্তি নিহত হন। চলতি বছরের জানুয়ারী , ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসে সিলেটে অন্তত অর্ধশত অস্বভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
পাথর কোয়ারির অংশ আরো একটু বড় হবে ॥ সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি এখন পরিণত হয়েছে মুত্যুকোপে। চলতি বছরেই জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরপিন ও লোভাছড়া পাথর কোয়ারিতে পাথর তোলার গর্ত ধসে অন্তত ২০ জন শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। শ্রীপুর পাথর কোয়ারির দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে গত ১৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে হোসাইন আহমদ নামের এক প্রবাসীর মৃত্যু হয়।
বিশিষ্টজনের বক্তব্য ঃ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশে সুশাসনের অভাবে এমন ঘটনা বৃদ্ধি পেতে পারে। নি¤œ আদালতে রায় উচ্চ আদালতে প্রতিফলিত হলে যে কোন অপরাধ সংঘটিত করার আগে ভয়ের সৃষ্টি হতো। এছাড়া, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় আসামীর বিরুদ্ধে যথাযথ সাক্ষী উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে অনেকে ছাড় পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সামাজিক অবক্ষয় থেকে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, সামাজিক অনুশাসন থেকে দূরে চলে যাওয়া সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দিক থেকেও অনেক দূরে অবস্থান করছি আমরা। এর বিপরীতে পশ্চিমা সংস্কৃতিসহ আমাদের মিডিয়াগুলো যেভাবে বিজাতীয় সংস্কৃতি উপস্থাপন করছে-সে দিক থেকে আমাদের সংস্কৃতির তেমন প্রচার বা প্রসার হচ্ছে না। এরজন্য বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মানুষের মনোভাবও বদলে যেতে পারে। ড. জসিম উদ্দিন আরো বলেন, অনেক সময় উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের মানসিকতায় নানা প্রভাব পড়তে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি সেই প্রভাবের প্রতিফলনও হতে পারে। সর্বোপরি চলমান অস্থিরতা দূর করতে সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন এ অধ্যাপক।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেন, আজকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, গত ৬ মাস আগেও সেটি ছিল না। অপরাধের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই-এই মন্তব্য করে পুলিশ কমিশনার বলেন, ঘটনার পর পরই এ্যাকশন নিলে অনেক সময় অপরাধ কমে আসে। আবার অপরাধ করার পর পরিণতি কি হতে পারে তা জানা সত্ত্বেও অপরাধ করছে। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের মাঝে বেশ অপরাধ প্রবণতা কাজ করছে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ছিনতাইকারী জেলেই তাকে। এরপর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সুযোগ পেলেই ছোবল মারে, যেটি মাহিদ হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
অনেক সময় বছরের মার্চ-এপ্রিল এলেই বাংলাদেশে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বলে যোগ করেন কমিশনার। পুলিশ সতর্ক অবস্থায় আছে এবং সাফল্যও পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এসএমপি’র শীর্ষ এ কর্মকর্তা।

এ বিভাগের অন্যান্য