আবারও ভর্তুকি কমানোর তাগিদ আইএমএফের

সিলেটের সময় ডেস্ক :

 

সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা হলেও ঝুঁকিতে পড়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন, সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন, আমদানি নিরুৎসাহিত করা- এসব উদ্যোগ অর্থনীতির ঝুঁকির বার্তা দেয়। সাধারণত একটি অর্থনীতির সক্ষমতার সূচকগুলো দুর্বল হলে ধীরে ধীরে ঝুঁকিতে পড়ে যায়। অর্থ বিভাগের সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, রাজস্ব আদায়ে চলছে ধীরগতি। রিজার্ভ পরিস্থিতিও নাজুকতার দিকেই যাচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়েও নেতিবাচকতা চলছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ লাগামহীন। মূল্যস্ফীতির চাপ অসহনীয়। বাজেট ভর্তুকি কমানোর কথা থাকলেও সরকার তা করতে পারেনি। ফলে ভর্তুকি কমাতে আবারও তাগিদ দিয়েছে আইএমএফ।

ঢাকা সফররত সংস্থাটির প্রতিনিধি দলটি গতকাল সোমবার অর্থ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকে তারা এ তাগিদ দিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইএমএফের সঙ্গে নানা ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকে চলছে, যা আগামী ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। এরপর তারা ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ছাড়ের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেবে। তার ওপর নির্ভর করবে নির্ধারিত সময়ে কিস্তি ছাড় হবে কিনা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণ নিয়ে গতকাল সোমবার বৈঠক হলেও এনবিআরের কৌশল নিয়ে আজ মঙ্গলবার আবারও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

সূত্র জানায়, সংকটে পড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তহবিল জুগিয়ে সচল রাখে সরকার। কখনো ভর্তুকি, আবার কখনো ধার হিসেবে এই অর্থ দেওয়া হয়। এভাবে অর্থ ঢালতে থাকায় গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ভর্তুকি ও ধার সরকারের তহবিল ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

অর্থ বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি ও ধার দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে এই প্রতিনিধি দল। এদিকে প্রতিবছরই রাজস্ব ঘাটতিতে থাকে সরকার। রাজস্বের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় ঋণ নিয়ে বাজেট ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। এই অবস্থার মধ্যেও লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমাগত অর্থ জোগান দিয়ে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে আইএমএফ।

অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের ধীরগতির বিষয়েও সন্তুষ্ট নয় আইএমএফ। চলতি অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছে। পরের দুই বছরে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছে। এই তিন অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়াতে হলে এনবিআরকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে, যা এনবিআরের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু রাজস্ব আহরণে এনবিআরের কৌশল সম্পর্কেও জানতে চায় আইএমএফ। গতকাল সোমবার আইএমএফ প্রতিনিধি দল এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক করে। বৈঠক শেষে এনবিআর চেয়ারম্যান কিংবা আইএমএফ প্রতিনিধি কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আইএমএফের প্রেজেন্টেশনে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।

সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকটি আজ মঙ্গলবার আবারও হওয়ার কথা রয়েছে। আইএমএফের তৈরি করা প্রেজেন্টেশনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্য ছিল ৬১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। তবে এনবিআরের পরিসংখ্যানে এখনো অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের তথ্য নেই। প্রথম দুই মাসের প্রাপ্ত তথ্য মতে, আগস্ট মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৪৬ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা।

আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ করে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হলে এনবিআরের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ও কাস্টমস খাতে ২৪ হাজার ৬০০ কোটি অতিরিক্ত আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা আয়কর খাতে, ৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা ভ্যাট খাত থেকে এবং ১১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা কাস্টমস খাত থেকে বাড়তি আদায় করতে হবে। এই টাকা কর-জিডিপি অনুপাতের শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ।

এনবিআরের আয়কর বিভাগ জানিয়েছে, ভূমি রেজিস্ট্রেশন থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা, ভ্রমণ কর থেকে ৫০০ কোটি টাকা, টোব্যাকো কর থেকে ৩০০ কোটি টাকা, পরিবেশ সারচার্জ থেকে ৫০০ কোটি টাকা, করের পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে ২৫০ কোটি টাকা, কার্বোনেটেড বেভারেজ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা ও বকেয়া কর আদায়ের মাধ্যমে ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা আদায় করা হবে।

ভ্যাট বিভাগ জানিয়েছে, সিগারেটের করহার বৃদ্ধির মাধ্যমে আসবে ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, মোবাইল ফোন, পলিপ্রোপাইলেন স্ট্যাপল ফাইবার, বল পয়েন্ট কলম, সফটওয়্যার, এলপিজির অব্যাহতি উঠিয়ে এবং কমিয়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ও ইএফডি মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করা হবে। যা কর-জিডিপি অনুপাতের শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

শুল্ক বিভাগে পরিকল্পনা অনুযায়ী, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে বকেয়া ৮ হাজার ৮০২ কোটি টাকা আদায়ের ব্যবস্থা, আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার পরিবর্তনের ফলে ১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ও অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা আদায় করা হবে। বাড়তি এই আদায় কর-জিডিপি অনুপাতের শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ।

তবে আয়কর খাতে ব্যক্তি শ্রেণির করহারের স্তর বাড়ানোর ফলে এবং সারচার্জ পরিবর্তনের ফলে কী প্রভাব পড়বে তার কোনো ব্যাখ্যা পায়নি আইএমএফ। এ ছাড়া পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রভাব, অপটিক্যাল ফাইবার, বিস্কুট ও কেক, মিষ্টিজাতীয় পণ্য, এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন ও পার্টসসহ বেশকিছু পণ্যের ওপর অব্যাহতি দেওয়ার ফলে কী প্রভাব পড়বে তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পায়নি সংস্থাটি। এ ছাড়া কাস্টমস খাতে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক অব্যাহতির প্রভাব সম্পর্কে অন্ধকারেই আইএমএফ।

এসব খাত বাংলাদেশের নমিনাল জিডিপির কত শতাংশ তা জানতে চেয়েছিল ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর কোনো ব্যাখ্যা পায়নি এনবিআরের লিখিত রূপরেখায়। আইএমএফের হিসাবে বাংলাদেশের নমিনাল জিডিপি ৫০ হাজার ৬৮ বিলিয়ন টাকা।

এ বিভাগের অন্যান্য