সিলেট বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক প্রকল্পে ধীরগতি

সিলেটের সময় ডেস্ক :

 

অন্তত পঞ্চাশ হাজার নতুন কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ এবং আন্তর্জাতিকমানের বহুমুখী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয় সিলেট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক। সীমান্তঘেঁষা ও প্রবাসীবহুল সিলেটে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে বড় বাণিজ্যক্ষেত্র তৈরির প্রত্যাশা ছিল এই প্রযুক্তিপ্রধান পার্ককে ঘিরে।

২০১৬ সালে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ১৬৩ একর জায়গাজুড়ে কাজ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কের। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন প্রকল্পটি। তবে এর পর আর গতি পাচ্ছে না প্রকল্পটি। স্থানীয় উদ্যোক্তা, প্রবাসী ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগের জন্য দেশি-বিদেশি ১৮ প্রতিষ্ঠানকে হাইটেক পার্কে জমি বরাদ্দ দেওয়া হলেও অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বিনিয়োগে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হলেও বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণকাজের তোড়জোড় নেই।

প্রকল্পের এমন ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সাংসদ ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ। বৃহস্পতিবার সিলেট বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে নলেজ পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যকালে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক আশা করে এখানে হাইটেক পার্ক নিয়ে আসা হয়েছে। এটি একটি সুদূর সম্ভাবনাময় প্রকল্প। শহর থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরত্বের এই হাইটেক পার্কের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যেই রেলস্টেশন ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রবাসী ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা এখানে বিনিয়োগ করবেন বলে আশা করেছিলাম। আমি তাদের উৎসাহও দিয়েছি। কিন্তু এখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা আগ্রহ পাচ্ছে না বা প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। এটি দূর করা দরকার।

তিনি বলেন, জমি বরাদ্দ নিয়ে সমালোচনা আছে। এক প্রতিষ্ঠানকে অনেক জমি না দিয়ে বহু প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দিলে তাতে প্রকল্পের ফল আরও ভালো হবে। যাদের বিনিয়োগের সম্ভাবনা আছে, তাদের কাছে বারবার যাওয়া দরকার বা তাদের ডাকা দরকার।

মন্ত্রীর বক্তব্য প্রদানকালে মঞ্চে ছিলেন হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিএসএম জাফরউল্লাহ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এখানে দেশের বড় কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। তারা অবকাঠামোগত কাজও শুরু করেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তা ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, তাদের আবারও আহ্বান জানানো হবে। সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা হবে। দ্রুতই আরও গতি পাবে সম্ভাবনাময় এ হাইটেক পার্ক।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে পুরোদমে উৎপাদনে যাবে ৩৩৬ কোটি টাকার এই প্রকল্প। স্থানীয় অদক্ষ শ্রমিকসহ কর্মসংস্থান হবে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের। উৎপাদিত পণ্য থেকে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা, পরিবর্তন আসবে সিলেটের

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে।

তবে কথা আর কাজে মিল না থাকায় এর আগে সিলেট সফরকালে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনও হতাশা ব্যক্ত করেন হাইটেক পার্কের কার্যক্রম নিয়ে। সদর উপজেলায় কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিলেটের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে ধীরগতি হতাশাজনক। সড়ক, বিমানবন্দর বা হাইটেক পার্ক সব জায়গাতেই আমরা সময়ক্ষেপণ লক্ষ্য করছি। এ ব্যাপারে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে, টাকা বরাদ্দ আছে অথচ কাজের কোনো অগ্রগতি নেইÑ এটি কেন হচ্ছে খোঁজ নিতে হবে।

শুরুতেই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে সিলেট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক। ঋণের সুবিধা না থাকা, বিনিয়োগ করা অর্থ উঠে আসা নিয়ে সংশয়, বিশ্ববাজারে মন্দা, ডলার সংকট, প্রকল্প এলাকায় বসবাসসহ অন্যান্য সুবিধা গড়ে না ওঠায় বিনিয়োগে অনাগ্রহ স্থানীয় ও প্রবাসী উদ্যোক্তাদের।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, আমরা এ নিয়ে দেশে-বিদেশে কর্মশালা, রোড শো কতকিছু করেছি। কিন্তু আগ্রহ দেখিয়েও অনেক বিনিয়োগকারী ফিরে গেছেন। ৪০ বছরের জন্য জমি দেওয়া হচ্ছে, এর বিপরীতে কাক্সিক্ষত ঋণ পাওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া সিলেট যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-সিলেট ছয় লেন ও সিলেট-তামাবিল চার লেন সড়ক প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল জব্বার জলিল বলেন, প্রকল্পের শুরুতে আমাদের জানানো হয়েছিল, এখানে অনেক আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি তৈরি হবে। আন্তর্জাতিকমানের শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে। বিদেশে আমরা প্রযুক্তি রপ্তানি করব। কিন্তু সবই এখন নিরাশা। তিনি বলেন, শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে স্থাপনের কারণে এ পার্ক ঘিরে একটি নতুন শহর স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজেরই কোনো অগ্রগতি নেই।

জানা গেছে, শুরুর আগেই বরাদ্দ ছেড়ে দিয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান। বরাদ্দ পাওয়া ও চুক্তিকৃত বাকি ১৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশির ভাগ এখনো কাজ শুরু করেনি।

হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ১২ প্রতিষ্ঠানকে ৭১.৩৯৯ একর জমি ও ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ভবন নির্মাণে ১৪ হাজার ৭৬০ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪০ বছরের জন্য। পরে মেয়াদ বাড়তে পারে। এর মধ্যে র?্যাংগস ইলেকট্রনিকস লিমিটেড ৩২ একর, আরএফএল ইলেকট্রনিকস লিমিটেড ২০, ব্যাবিলন রিসোর্সেস লিমিটেড ২, হেলথ ল্যান্ডমার্ক হোল্ডিং লিমিটেড ১.৫, রহমানিয়া সুপার মার্কেট ১, টুগেদার আইটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ১, ইএলবি ১, মেসার্স নুহ এবং সোহান এন্টারপ্রাইজ প্রায় সাড়ে ৩, অটোমেশন সার্ভিস লিমিটেড ১, আরটিএম আল কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি ৮, ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্টস লিমিটেড ০.১৪৯, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড ০.৩৩০ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে। পাঁচতারকা হোটেলের জন্য ৩ একর, বোর্ড ক্লাবের জন্য ২ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে ৪ হাজার বর্গফুট, সিমেড হেলথ লিমিটেডকে ১ হাজার, নুডস সল্যুশনকে ১ হাজার ৫০০, মেসার্স আবদুল বাসির এন্টারপ্রাইজকে ২ হাজার ২৬০, ইন টাচ আইটিকে ২ হাজার ?বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছয়টি সিলেট অঞ্চলের। বছরে প্রতি বর্গমিটার জমির ভাড়া দেড় মার্কিন ডলার এবং মাসে প্রতি বর্গফুট জায়গার ভাড়া ৫ টাকা, সার্ভিস চার্জ ৫ টাকা।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) ব্যারিস্টার মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, এখানে সফটওয়্যার, ইলেকট্রনিক পণ্য ও যন্ত্রাংশ তৈরি হবে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। যেসব প্রতিবন্ধকতার জন্য উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা দূর করতেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এ বিভাগের অন্যান্য