হাওরের বোরো ধান কাটায় শ্রমিক সংকট
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুরসহ হাওরবেষ্টিত সবকটি উপজেলার বোরো ধান কাটায় তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কৃষকদের মধ্যে সময়মতো ধান কাটা নিয়ে রয়েছে সংশয়। গত কয়েক দিন ধরে জেলার বিভিন্ন হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হয়। আর ধান কাটার শুরুতেই শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে হাওরে। এমনকি আগাম টাকা দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। টানা ২ বছর হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ায় দরিদ্র কৃষি শ্রমিকরা এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় কুমিল্লা, নোয়াখালী, পাবনা, বগুড়া, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকরা ধান কাটতে হাওর এলাকায় আসত। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এসব শ্রমিকরা আসতেন ধান কাটতে। তবে গত কয়েক বছর ধরে হাওরে ফসলহানীর কারণে তারা এখন আর ধান কাটতে আসেন না।
তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়াইন হাওরের কাউখান্দী গ্রামের কৃষক শামছু মিয়া বলেন, ১৫ বছর আগেও পৌষ মাসে ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটা শ্রমিক (ভাগালো) এসে কৃষকদের অগ্রিম টাকা দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে যেত। পরে বৈশাখে এসে ধান কাটত। শ্রমিকরা পৌষ মাসে আসার সময় গুড়সহ নানা রকম উপঢৌকন নিয়ে আসত কৃষকদের জন্য। আর যাওয়ার সময় ধান বা নগদ টাকা দিয়ে তাদের অগ্রিম দেয়া টাকা শোধ করার পাশাপাশি তাদেরও উপঢৌকন হিসেবে খাসি দিয়ে দিতেন কৃষকরা।
উপজেলার টাংগুয়ার হাওরপাড়ের কৃষক শিপন মিয়া বলেন, এ বছর ৫ হাল (৬০ বিঘা) জমি চাষাবাদ করেছি। ৩/৪ দিন পর ধান কাটা শুরু হবে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও শ্রমিক পাচ্ছি না। শেষে বিশ্বম্ভরপুরের মিয়ারচর থেকে ১৬ জন শ্রমিক পেয়েছি। তারা প্রতি কেয়ার (৩০ শতক) ২ হাজার টাকায় ধান কেটে দেবে এবং তাদের দুবেলা খাবারো দিতে হবে। ধান মাড়াইসহ অন্যান্য কাজ আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।
বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার জালালপুরের কৃষক ফজলু মিয়া বলেন, অনেক কৃষকই শ্রমিক পাচ্ছেন না। যারা ফাল্গুন বা চৈত্রের প্রথম দিকে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা ছাড়া অন্যরা অগ্রিম টাকা দিয়েও ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছেন না। তিনি আরো জানান, টানা দুবছর ধানের গোটা আসার আগেই হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জীবিকার তাগিদে হাওরপাড়ের গ্রামগুলোর শ্রমিকরা সিলেটের ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ, ঢাকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজের সন্ধানে চলে গেছে। এদের বেশির ভাগই এখনো এলাকায় ফিরেনি। শ্রমিক সংকটের কারণ উল্লেখ করে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রাধানগর গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, এ বছর সেচের অভাবে ও সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় খড়ায় হাওরে ধানের ফলন কম হয়েছে। এতে শ্রমিকরা ভাগে ধান কাটতে আগ্রহী হয় না। টাকার বিনিময়ে ধান কাটতে চায় এবং হাওরে এখন বোরো ধান কাটার বিনিময়ে টাকা নেয়ার প্রথা চালু হয়েছে, যা আগে ছিল না। টাকার বিনিময়ে ধান কাটলে কৃষকদেরও পোষায় না। এক কেয়ার বোরো ধান কাটতে ২ হাজার টাকা লাগে। আর এ বছর ধান হয়েছে প্রতি কেয়ারে মাত্র ৩/৫ মণ। বাজারে নতুন বোর ধান ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া অনেক শ্রমিক বেশি মজুরিতে বালি-পাথর কুয়ারিতে কাজ করতে চলে যায়।
উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক শিপলু বর্মণ বলেন, তার ৬ কেয়ার জমি ১২ হাজার টাকা দিয়ে কাটিয়েছেন। এ রকম অনেকেই বেশি টাকা দিয়ে ধান কাটাচ্ছেন। অনেক কৃষক শ্রমিক না পেয়ে হতাশার মধ্যে রয়েছেন। কারণ সময়মতো ধান কাটতে না পাড়লে শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী, প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের ভয় রয়েছে।
জেলা প্রসাশন সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে হাওর এলাকার পার্শ্ববর্তী বালি-পাথর কুয়ারি আগামী ৫ মে পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক আবদুল আহাদ ভোরের কাগজকে জানান, হাওরের ধান কাটার শ্রমিক সংকট যেন না হয়, সেজন্য আগামী ৫ মে পর্যন্ত পাথর কুয়ারি বন্ধ রাখা হয়েছে। কৃষকেরা যদি ধান গোলায় না তুলতে পারেন, তাহলে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হবে। এ জন্য সবাইকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। আমরা কৃষকের কষ্টে ফলানো সোনালি ফসল নষ্ট হতে দেব না।