সিলেটে থামছে না আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কাজ,দুই পক্ষেরই টার্গেট মুনাফা

 ‘বেআইনি কাজ’ জেনেও আবাসিক ভবনে অবৈধ ব্যবসার পসরা
 পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে

মবরুর আহমদ সাজু

বাণিজ্যিক আগ্রাসনে সিলেটের আবাসিক এলাকাগুলো নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল; সেই সিসিকের নাকের ডগায় এই অবাঞ্ছিত রূপান্তর ঘটছে জোরেশোরে। নগর ভবনের কর্তারা এ ক্ষেত্রে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে আছন্ন। তাদের নীরব ভূমিকায় নগরীর আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।
নগরবিদদের মতে, সিলেট নগরীর আবাসিক এলাকাকে বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করার অবৈধ প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কয়েক দশক আগে সিলেটে যেখানে চারতলার ওপরে কোনো ভবন ছিল না সেখানে, এখন ইচ্ছামতো উচ্চতায় দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। আর এসব ভবন ভাড়ায় দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। এখন সিলেটের চারপাশে এ ভাইরাস সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করেছে। নগরীতে বাণিজ্যিক প্রয়োজনের জন্য আলাদাভাবে নকশা করা থাকলেও পুরো বিষয়টি গোপন করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। ফলে ধীরে ধীরে ঘিঞ্জিতে পরিণত হতে চলেছে পরিকল্পিত নকশায় গড়ে ওঠা সিসিকের অনেক আবাসিক এলাকা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সিলেট নগরীর আবাসিক ভবনগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে হাসপাতাল, ক্লিনিক, সুপারশপসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। আবাসিক ভবনের মালিকরা নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তাদের ভবনের নিচতলা আবার কখনো দুতলা কখনো বা গোটা ভবনই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দিচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের আবাসিক এলাকা শাহজালাল উপশহর এখন ব্যস্ততম জনবহুল বাণিজ্যিক এলাকা। উপশহর মেইন রাস্তার দুই পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে একাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও কাস্টমসের মতো সরকারি অফিসের পাশাপাশি মূল সড়কের পাশে পরিচালিত হচ্ছে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে রয়েছে ক্লাসিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সানিহিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সিলেট যুব একাডেমী, মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র, নিটল মটরস, ডাইনেস্টি, বার্জার পেইন্ট, পোলার আইসক্রিম, সিলেট ক্যাডেট মাদ্রাসাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।
মূল সড়ক শুধু নয় উপশহরের সব ব্লকের অলিগলিতে বাসা ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, আইডিয়া, গ্রামীণ ব্যাংক, এসএসকেএস, বন্ধু, আশার আলো, ভার্ড স্থান করে নিয়েছে উপশহরে। একই সঙ্গে কৃষি অধিদপ্তর, মূল্য সংযোজন কর মূসেকর মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ চলছে উপশহরে বাসা ভাড়া নিয়ে। উপশহর ছাড়াও নগরের দাড়িয়া পাড়া, মির্জাজাঙ্গাল, লামাবাজার, নবাবরোড, শিবগঞ্জসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ছড়া ছড়ি রয়েছে।
জানা যায়, ভবনের মালিকরা মোটা অঙ্কের ভাড়া পাওয়ার লোভে আবাসিক ভবনে খাবার দোকান, মুদি দোকান, ফ্লেক্সিলোডের দোকান, ফার্মেসি, টেইলার্স, বিউটি পারলার, তৈরি পোশাকের দোকান, সেলুন, জিমনেশিয়াম, লাইব্রেরি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য মেরামতের দোকান ভাড়া দিয়েছেন। এমনকি কিছু ভবনের ছাদে আবার মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার ও বিলবোর্ড বিপজ্জনকভাবে বসানো রয়েছে। এ ছাড়াও এসব ভবনে ্ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে কোচিং প্রতিষ্ঠান। কিছু আবাসিক এলাকায় আবার বিভিন্ন এনজিও, ট্রাভেল এজেন্সি এবং আইটি প্রতিষ্ঠানকে ঠাঁই দিয়েছে।
সিলেট নগরীর হাওয়াপাড়া, উপশহর, জল্লারপার, মির্জাজাঙ্গাল বাসা বাড়ি মালিকদেকর সাথে কথা বলে জানা যায়, আবাসস্থল হিসেবে দিলে যে ভাড়া পাওয়া যাবে তার থেকে অনেক বেশি পাওয়া যাবে যদি তা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। কাজেই ভবন বানানোর সময় বাড়ির সামনে এক চিলতে খোলা যে জায়গা রাখা হয় পরে বাড়তি ভাড়ার লোভে সেখানেও মালিকরা ছোট ঘর বানিয়ে ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিচ্ছেন।
সচেতন নগরবাসী বলছেন, ভবনের মধ্যে খাবার হোটেল থাকায় দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ ও ঝাঁঝালো ঘ্রাণের মধ্যেই তাদের সবসময় বসবাস করতে হচ্ছে। বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে যে-কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলেও শঙ্কা তাদের।
পরিবেশবিদরা জানান, একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার জন্য দরকার ফায়ার স্টেশন, কমিউনিটি সেন্টারসহ প্রয়োজনীয় বেশ কিছু স্থাপনা। কিন্তু এগুলোর বদলে এখন অপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক স্থাপনায় ভরে যাচ্ছে আবাসিক এলাকা।
সিসিকের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাঁজ বলেন, আমি যতটুকু জানি সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে নকশার অনুমোদন আনার সময় স্পষ্ট বলা হয় কখনো বাড়ি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করবেন না। কিন্তু বেশি ভাড়া নিয়ে তারা বাড়িগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে, এটা আইনের ব্যাপার।
সিলেটে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী এ রকমই অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, নগরীতে যে দিকে চোখ যায় সেদিকে আবাসিক ভবনে চলছে আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কাজ। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এরকম কার্যক্রম চলছে যা একান্ত কাম্য নয়। তিনি নগর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যারা এরকম করছে তাদের কে একলক্ষ টাকা করে জরিমানা করা উচিত।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইনঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড.মোহাম্মদ আজিজুল হক বলেন, প্রতিটি শহরের একটি চরিত্র থাকে। সেখানে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে আবাসিকের স্থলে বাণিজ্যিক কাঠামো তৈরি করা হলে মানুষ নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারবে না। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। খেলার মাঠের অভাবে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, আইন অমান্য করে যারা প্রশাসনের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে কার্যক্রম করছে তারা সমাজের অভিশাপ। কারন হিসেবে তিনি বলেন, আবাসিক ভবনের স্টাকচার আর বাণ্যিজিক ভবনে স্টাকচার এক রকম নয়।
নগরীর হাওয়া পাড়ায় দেখা যায়, সেখানে খাওয়ার দোকান থেকে শুরু করে গাড়ির গ্যারেজ, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ এলাকার কয়েকজন বাড়ি মালিক জানান, নতুন এ সড়কের ভবন বা গ্যারেজ মানুষ ব্যবসায়িক কাজে বেশি ভাড়ায় নিতে আগ্রহী। ভালো ভাড়া পাওয়ায় তাদেরও এতে কোনো আপত্তি নেই।
জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল কাদের মোজাহিদ বলেন, আবাসিক বাড়িগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে মুনাফা লাভ করা এটা কোনো মতো মেনে নেয়া যায় না তবে আমরা কিছুদিনের মধ্যে অভিযানে নামবো।
জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা দেবজিৎ সিংহ বলেন, বিষয়টি আমি অবগত। আমাদের কাছে এই মুহুর্তে কিছু করার নেই। তবে আমরা ডাটাবেজ তৈরি করে এটার এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবো।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা আছে। আমরা একাধিকবার তাদের নোটিশ দিয়েছি, কিন্তু তারা আমাদের কোনো নোটিশই রেসপন্স করছে না। এখন আমরা কী করব। আমরা বিষয়টি কাকে লিখছি। তিনি বলেন, মন্ত্রনালয় থেকে নির্দেশ এসেছে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য।

এ বিভাগের অন্যান্য