নারীর জয়যাত্রা সর্বত্রই
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে সমাজের ** সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে এখন নারী ** ঘরে-বাইরে তাদের জয়জয়কার
‘…সেদিন সুদূর নয়/যে দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’ প্রায় এক শতাব্দী আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই আকাঙ্ক্ষা আজ বাস্তবে ধরা দিয়েছে। এখন অনায়সে বলা যাচ্ছে- ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।’ নারীর জয়যাত্রা এখন সর্বত্রই। নারী তার আপন মেধা-যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। এক কালের ‘অবরোধবাসিনী’ নারীর এখন ঘরে-বাইরে জয়জয়কার। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীও বদলে গেছে নারীর প্রতি। গৃহে এবং বহিরাঙ্গনে দুই জায়গাতেই তারা ‘দশভূজা’ হয়ে উঠেছেন। জীবনের সব রঙ আর কর্মচাঞ্চল্যতা দিয়ে কর্মজীবী নারী সাজাচ্ছে তার জীবন।
‘যে রাধে সে চুলও বাধে’-এই প্রবাদ এখন সত্য হয়ে উঠেছে। পরিবার, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে সর্বত্রই নারী সাফল্য পেতে নেমেছে চ্যালেঞ্জ নিয়ে। কর্মজীবী নারীর চ্যালেঞ্জটা যেন একটু বেশি। সংসার-সন্তান সামলে কর্মক্ষেত্রকেও দিতে হয় সমান গুরুত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন তিনগুণ। দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির মূল কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান ক্রমাগত বাড়ছে। সমীক্ষা অনুসারে, মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উত্পাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, চিকিত্সক, স্থপতি, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ব্যাংকার, নির্মাতা থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মী পদেও পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন নারী। সংখ্যায় নগণ্য হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী ও উচ্চপদেও দায়িত্ব পালন করছেন তারা। তবে নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী। এক গবেষণায় দেখা যায়, কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিক বেশি। তবে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে এখনও তারা পিছিয়ে রয়েছেন। কৃষি, শিল্প, সেবা খাতসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়লেও জাতীয়ভাবে পিছিয়ে পড়ছেন তারা। কায়িক শ্রমে নারীদের অংশ নেওয়ার হার অব্যাহত রয়েছে। বসতবাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, উত্পাদন, গোয়ালঘর নির্মাণ, পরিষ্কার, এদের খাওয়ানো ও পরিচর্যাসহ গবাদিপশু সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণের হার শতকরা ৪৪ থেকে ৮৫ শতাংশ। যেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ সর্্বোচ্চ ৫০ শতাংশ মাত্র। এ চিত্র পাওয়া যায় অ্যাকশন এইডের এক গবেষণা থেকে। ওই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারীরা তাদের প্রতিদিনের কাজের অন্তত ৪০ শতাংশ পরিবার ও স্বজনের পেছনে ব্যয় করেন। কিন্তু তারা এ ৪০ শতাংশ কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। বিবিএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। নারীরা ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট কাজ করেন। জিডিপিতে নারীদের রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালনসহ গৃহস্থালির কাজকর্মের স্বীকৃতি নেই। এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমানও নির্ধারণ করা হয় না। ফলে অর্থনীতিতে নারীর এ কাজের অবদান আড়ালেই থাকছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। কিন্তু সামপ্রতিক বছরগুলোতে রাজনীতিতে নারীর ক্রমবর্ধমান সাফল্য নিয়ে তর্ক করার আর কোনো অবকাশ নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বাইরে বিরোধী দলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার ছাড়াও সরাসরি নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনের অনেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও সচিব নারী। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আবার তাদের কাজের স্বীকৃতিতে পুরস্কৃতও হয়েছেন। নারীদের কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের জোয়ার বইছে ঘরে-বাইরে সর্বত্র। এসব কারণেই নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসাবে সমাদৃত এবং প্রশংসিত হচ্ছে। অনুরূপ পুলিশ প্রশাসনে থানার ওসি, এএসপি, এসপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজিপি, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়েও কর্মরত আছেন বহু নারী। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকও নারী। স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁরা তাদের সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ক্রীড়াঙ্গনে একের পর এক সাফল্যের জোয়ার বয়ে আনছে বাংলাদেশের মেয়েরা। অর্থাত্ ভূমি থেকে মহাকাশ, আকাশ থেকে শুরু করে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় বিজয়ের পদচিহ্ন এঁকে চলেছেন বাংলাদেশের অদম্য এবং আলোকিত নারীরা। দেশের রাজনীতি, প্রশাসনে, সংসদে, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য আর অগ্রযাত্রায় বিশ্বকে জয় করে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের অপরাজিতারা।
একই ভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশি তিন কন্যার জয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। নিজ নিজ আসনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রূপা হক। মেধা ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে যে কজন বাংলাদেশি নারী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত, এর মধ্যে একজন সোনিয়া বশির কবির। টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁকে নিয়োজিত করেছে বেশ আগেই। নতুন আরও তিনটি দেশ নেপাল, ভুটান ও লাওসে মাইক্রোসফট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছেন। সমপ্রতি জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলি সপ্তাহে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) সংক্রান্ত সেরা ১০ পথিকৃতের একজন হিসেবে ইউএন গ্লোবাল কমপ্যাক্ট সোনিয়া বশির কবিরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রার পথে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এই নারী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসা থেকে ‘ইনভেন্টর অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের মাহমুদা সুলতানা। তিনি বিভিন্ন ন্যানোটেক কাউন্সিলে নাসার প্রতিনিধিত্ব করছেন। সাত বছর ধরে নানা রকম প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও কঠিন পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের দুজন নারী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও তামান্না-ই-লুতফী। অদম্য, আলোকিত নারীরা এই ভাবেই একে একে বুনেছেন সফলতার গল্প আর পাশাপাশি দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন জয়ের বার্তা। আকাশছোঁয়ার স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার বাস্তবতায় কঙ্গোর অচেনা আকাশকেও হার মানিয়েছে অদম্য অপরাজিতাদের হাত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আইভরি কোস্টে মেডিকেল কন্টিজেন্ট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রথম বাংলাদেশি নারী কর্নেল নাজমা বেগম। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টও দুর্গম নয় বাঙালি নারীদের কাছে। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন নিশাত মজুমদার। এরপর আরেক বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীনও এভারেস্টের বুকে এঁকে দেন বিজয়ের পদচিহ্ন। বাংলাদেশের সাহসী নারীদের ধারাবাহিক সাফল্যের প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাধারণ বীরত্বের গল্প।
বৈশ্বিক বিচারে বাংলাদেশের সাফল্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম স্থানে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাংলাদেশের নারীর অবস্থান ১৩০তম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অবস্থানের ক্ষেত্রে গত বছরের মতো এবারও পৃথিবীতে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ গ্রাম-শহরে নারীর কর্মজীবনকে দৃশ্যমান করেছে। দেশের আয়বর্ধক কর্মকান্ড তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে নারী সমাজের অংশগ্রহণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে কম সুযোগ পাওয়া নারীর জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইনি পরামর্শ সহজলভ্য হওয়ার কারণে নারীর জীবনযাত্রার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্র্রা তহবিলের (আইএমএফ) গত বছরের বার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৭ শতাংশ ছিল নারী। বর্তমানে তা বেড়ে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নারী উন্নয়ন ও সমতার লক্ষ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল ও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রের আলোকে নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নকল্পে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ মহিলাবিষয়ক অধিদফতরে ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ও উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য জাতীয় বাজেটে নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা বরাদ্দ। বিগত বছরগুলোর বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সাত বছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ পাঁচগুণেরও বেশি বেড়েছে। যা নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
নারী নেত্রীরা বলছেন, সার্বিক বিচারে নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেলেও জাতিসংঘের সিডও সনদ অনুযায়ী নারীর প্রতি বৈষম্য এখনও দূর হয়নি। তবে কেটে যাচ্ছে সেই পরিবেশ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম মনে করেন, নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রথমে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। যেটা ধীরে ধীরে হচ্ছে।