ফিরে দেখা ১০টি সংসদ নির্বাচন প্রবাসি অধ্যুষিত আসন সিলেট-২


ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নির্বাচনী ঝড় ততই ঘণিভূত হচ্ছে সবকটি নির্বাচনী এলাকায়। ভোট এলেই দেশজুড়ে এক ধরনের উš§াদনাও তৈরি হয়। উৎসবের আমেজেও রঞ্জিত হয়ে উঠে বাঙালী জীবন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। ভোটররা ভোট দিনের অপেক্ষায় আছেন। এই প্রেক্ষাপটে সিলেট-২ আসনের পিছনের দশ সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস তুলে ধরা হলো।
১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট দশটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসি অধ্যুষিত সিলেট-২ আসন তৎকালীন সিলেট-৭ আসনের অর্ন্তভূক্ত ছিলো। বিশ্বনাথ-দক্ষিণ সুরমা, পরবর্তি বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানী নগর ও বর্তমান বিশ্বনাথ-ওসমানী নগর উপজেলা নিয়ে গঠিত। গত দশটি নির্বাচনে এই আসনে বিএনপি’র প্রার্থী ৪বার, আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৩বার ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ৩বার করে নির্বাচিত হয়েছেন। সে হিসেবে এই আসনে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি।
বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৩ সালের ৭মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে। এ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন নুরুল ইসলাম খান। তিনিই ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ট সাংসদ। সংসদের মেয়াদ ছিলো ৭ এপ্রিল ১৯৭৩ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত।
২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মাত্র ছয় মাস আগে প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ২০৭টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মরমী কবি হাছন রাজার উত্তরসূরী দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী। সংসদের মেয়াদকাল ছিলো ২ এপ্রিল ১৯৭৯ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ পর্যন্ত।
তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। সংসদের মেয়াদকাল ছিলো ১০ জুলাই, ১৯৮৬ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭ পর্যন্ত। দেড় বছর মেয়াদের এই সংসদে ইনামুল হক চৌধুরী সাংসদ নির্বাচিত হন।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। নির্বাচনটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অধিকাংশ দল বর্জন করেছিল। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ওই সময়ে জাতীয় পার্টির মকসুদ ইবনে আজিজ লামা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ওই নির্বাচনে এ আসনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ৯৭ হাজার ২৬৫ জন ভোটার। জাতীয় পার্টি থেকে মকসুদ ইবনে আজিজ লামা লাঙ্গল প্রতিকে ৩৩ হাজার ৪১৬ ভোট পেয়ে ২য় বারের মত সাংসদ নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) থেকে মো: লুৎফুর রহমান পান ২২ হাজার ৮৭ ভোট। সংসদের মেয়াদকাল ছিলো ৫ এপ্রিল, ১৯৯১ থেকে ২৪ নভেম্বর ১৯৯৫ পর্যন্ত।
ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। আওয়ামী লীগ সহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ২৭৮টিতে জয়লাভ করেছিল। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির এম. ইলিয়াস আলী। মাত্র চার কার্যদিবসে সংসদ বসার পর তা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে নিরপেক্ষ নির্বাচন একই বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
সপ্তম সংসদ নির্বাচন ১২ জুন ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচন। ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন হয়। ওই নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোট সংখ্যা ছিল ২লাখ ২হাজার ৪১১। এরমধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ১লাখ ৩১হাজার ৪৯৭জন ভোটার। আওয়ামী লীগ থেকে শাহ আজিজুর রহমান নৌকা প্রতিকে ৪২ হাজার ২৬৬ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি জাতীয় পার্টির মকসুদ ইবনে আজিজ (লামা) লাঙ্গল প্রতিকে পান ৩৯ হাজার ৪৪ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ৩হাজার ২২২। এ আসনে বিএনপি’র প্রার্থীসহ ৯জন প্রার্থী অংশ নেন। সংসদের মেয়াদকাল ছিলো ১৪জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১৩জুলাই ২০০১ পর্যন্ত।
৮ম সংসদ নির্বাচন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ১অক্টোবর ২০০১সালে। নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আসনে জয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করে। বিএনপি থেকে এম. ইলিয়াস আলী ধানের শীষ প্রতিকে ১লাখ ৩হাজার ৪৬০ ভোট পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি আওয়ামী লীগ থেকে শাহ আজিজুর রহমান নৌকা প্রতিকে পান ৫৫ হাজার ২৯১ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ৪৮হাজার ১৬৯টি। মোট ভোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩১৩। এরমধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ১ লাখ ৯০ হাজার ৭জন ভোটার। সংসদের মেয়াদকাল ছিলো ২৮অক্টোবর ২০০১ থেকে ২৭অক্টোবর ২০০৬ পর্যন্ত।
৯ম সংসদ নির্বাচন ২০০৮ সালের ২৯ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ২৬৩ পেয়ে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরী নৌকা প্রতিকে ১লাখ ৯হাজার ৩৫৬ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি বিএনপির এম ইলিয়াস আলী ধানের শীষ পান ১লাখ ৬হাজার ৪০। ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ৩ হাজার ৩১৬। এই সংসদের মেয়াদকাল ছিলো ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনটি নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ কয়েকটি দলই বর্জন করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও সতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া লাঙ্গল প্রতিকে ৪৮হাজার ১৫৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি সতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান আনারস প্রতিকে পান ১৭ হাজার ৩৮৯ ভোট। আসনে মোট ভোট সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬২২। এই সংসদের মেয়াদকাল ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
একাদশ সংসদ নির্বাচন চলতি মাসের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্ধিতায় আছেন ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া (জাতীয় পার্টি), তাহসিনা রুশদীর লুনা (বিএনপি), মুনতাসির আলী (মজলিস), মাওলানা আমির আলী (শাসনতন্ত্র আন্দোলন) মোকাব্বির খান (গণ ফোরাম)। এ আসনে নৌকা প্রতিক না পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মিরা। তাদের মাঝে নির্বাচনী উৎসবের আমেজ নেই বললেই চলে। বর্তমানে প্রার্থীদের মধ্যে এককভাবে আলোচনায় রয়েছেন কেন্দ্রিয় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক ও সাবেক সাংসদ নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিনী বিএনপির প্রার্থী তাহসিনা রুশদীর লুনা।
নির্বাচন অফিসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ৬ আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোটার সিলেট-২ আসনে। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২লাখ ৮৬হাজার ৩৮০জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১লাখ ৪৪হাজার ৮৩৫। নারী ভোটার ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৪৫। এই ভোটারদের রায়েই আগামী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচিত হবেন আগামীর সংসদ সদস্য।
দশটি সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা হলে এই আসনের প্রথম সাংসদ ও বর্তমান জাতীয় জনতা পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম খান দৈনিক শুভ প্রতিদিনকে বলেন, যত দিন যাচ্ছে ততই নির্বাচনের আমেজ কমে যাচ্ছে। আগের নির্বাচনগুলো ছিল উৎসব, উদ্ধেগ আর উচ্ছাসের। ১ম নির্বাচনে জয়লাভ করতে তাকে কোন টাকা খরচ হয়নি। আর বর্তমানে নির্বাচন মানেই হচ্ছে টাকার খেলা।

এ বিভাগের অন্যান্য