নতুন প্রজন্মের হাতে ফুটবলের ‘সোনালি সূর্য’

কাঠমাণ্ডুতে উঠেছে বাংলাদেশ ফুটবলের ‘সোনালি সূর্য’। তার প্রখর তেজে কাল জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেল পাকিস্তান। প্রতিপক্ষ আকার-আকৃতিতে ছাড়িয়ে গেলেও পারফরম্যান্সে রঙিন হয়ে গেল লাল-সবুজের কৈশোর। ১-১ গোলে সমতার পর টাইব্রেকারে পাকিস্তানকে ৩-২ গোলে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপার রংমশাল উড়িয়েছে বাংলাদেশ।

এই মশাল মিছিলের নেতা মেহেদী হাসান। এই বদলি গোলরক্ষক যেন ম্যাজিকম্যান। ম্যাচের ৯০ মিনিটে মিতুলের জায়গায় নামতেই অন্য রকম এক বিশ্বাসের সঞ্চার হয় পুরো দলে। নিয়মিত গোলরক্ষক মিতুলেরও ছিল সেই বিশ্বাস, ‘মেহেদী পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিস্ট। সে দুটি দুর্দান্ত সেভ করে আমাদের সেমিফাইনাল জিতিয়েছে। ফাইনালেও সে কিছু একটা করবে—এমন বিশ্বাস দলের ভেতর ভীষণভাবে কাজ করছিল।’ সেটারই অবিশ্বাস্য প্রতিদান দিয়েছে মেহেদী হাসান তিন-তিনটি দুর্দান্ত সেভ করে। টাইব্রেকারের শুরুতে ডান-বাঁয়ে দুটি ডাইভেই আটকে যায় পাকিস্তানের জুনায়েদ ও আদনান। পরের দুই শটেও ডাইভ হয়েছিল ঠিকঠাক কিন্তু ঠেকাতে পারেনি। পাঁচ নম্বর শটেও আবার মুদাস্সরকে ঠেকিয়ে দিলে বাংলাদেশের রাজন হাওলাদার ও রবিউলের মিসের মাসুল বড় হতে দেয়নি। ‘আমি প্রচণ্ড খুশি। আগের ম্যাচ থেকেই আমি আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলাম। যখন নামছি, তখন মনে হচ্ছিল আমরা পারব। কোচের আস্থার প্রতিদান দিয়ে দেশকে দারুণ এক শিরোপা উপহার দিতে পেরেছি, এটা খুব আনন্দের ব্যাপার’—ফোনের ওপ্রান্তে আনন্দে আত্মহারা ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়টি।

ম্যাচের শুরুতে দুর্দান্ত খেলে বাংলাদেশের ছেলেরা। শারীরিক আকারে পাকিস্তান এগিয়ে থাকলেও ম্যাচের প্রথম ৩০ মিনিট দাপট ছিল লাল-সবুজের। ৩ মিনিটে তো রাসেল পায় ম্যাচের সেরা সুযোগটি। বাঁ-দিক দিয়ে ঢুকে ওয়ান-ওয়ানে গোলরক্ষকের হাতে বল তুলে দিয়ে নিজের চুল নিজে ছেঁড়ার মতোই মহা ভুল করে। মিনিট দশেক বাদে রাসেলের স্ট্রাইকিং পার্টনার উচ্ছ্বাস পারেনি ফিনিশ করতে। চার গোল করা টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার কাছ থেকে ফাইনালে আরেকটি গোল আশা করতেই পারে দল। তাদের ব্যর্থতা অবশ্য বড় হতে দেয়নি হাসিব, ২৫ মিনিটে বাংলাদেশের কর্নার কিকে হেড করে এই পাকিস্তান অধিনায়ক বল জড়িয়ে দেয় নিজেদের জালে! আত্মঘাতী গোলে লিড নেওয়া বাংলাদেশের খেলা যখন আরো ভালো হবে তখন হয়েছে খারাপ। এটাই ছিল পাকিস্তানের সুযোগ এবং তারা চাপ বাড়াতে থাকে ক্রমশ। সেই চাপের মুখে বাংলাদেশ ডিফেন্ডার করে বসে বড় ভুল, পেনাল্টি বক্সে এক পাকিস্তানিকে ফাউল করে ডেকে আনে পেনাল্টির বিপদ। ওই সময়ে গোলরক্ষক মেহেদী হাসানকে খুব মনে পড়েছিল। মিতুল যে পেনাল্টি ঠেকানোর ‘ওস্তাদ’ নয়, তাই মহিবুল্লাহ বল জালে জড়িয়ে দিয়ে ম্যাচে ফেরায় পাকিস্তানকে। এরপর ৭৪ মিনিটে এগিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ এলেও উচ্ছ্বাসের সুন্দর হেডে পাকিস্তান গোলরক্ষকের হাতে জমে গেলে নিয়তি আবার সেই টাইব্রেকারে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে।

তখন ভাগ্যকে সঙ্গে নিয়ে স্বপ্নের রং মাখাতে হাজির গোলরক্ষক মেহেদী হাসান। সেমিফাইনাল জেতানো এই গোলরক্ষকের হাতেই যে শিরোপার জাদু। সেই জাদুতে বাংলাদেশ ফুটবলের সোনালি সূর্য উঠেছে কাঠমাণ্ডুতে। মামুনুল-জাহিদ হোসেনদের পর আর কোনো প্রজন্ম আসেনি দেশের ফুটবল রাঙাতে। আসেনি কোনো তারকা, যাদের ঘিরে বুক বাঁধা যায় নতুন আশায়। ২০১৫ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল জয়ের পরও সেই বিজয়ীদের নিয়ে হয়েছিল অনেক আলোচনা। তৈরি হয়েছিল আশা। ফুটবলকর্তাদের পরিকল্পনাহীনতায় সেই সম্ভাবনা মিলিয়ে যাওয়ার দুই বছর পর আবার অনূর্ধ্ব-১৫ দল নতুন সম্ভাবনার বাঁকে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে ফুটবলকে। তার কৃতিত্ব অবশ্যই পাবেন দলের কোচ মোস্তফা আনোয়ার পারভেজ, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবাই পরিশ্রম করছে। আমরা ধাপে ধাপে সামনে এগিয়ে গেছি। আজ যেন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিলাম আমরা। অন্য রকম এক স্পিরিট কাজ করছিল সবার মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও আমরা জিতেছি।’ যুদ্ধের সুফলটা যদি শেষ পর্যন্ত দেশের ফুটবলে ইতিবাচক পথে নিয়ে যায়।

এ বিভাগের অন্যান্য