ভাঙছে বিকল্পধারা

ভেঙে যাচ্ছে এ সময়ের আলোচিত রাজনৈতিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ। শীর্ষ নেতাদের ‘চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে’ ক্ষুব্ধ হয়ে দলটির একাংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যেই এ অংশের নেতারা তলবি সভা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর এবার ভোটের অধিকার আদায়সহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একই সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিও নিতে চাইছে এ জোট।

এ লক্ষ্যে নতুন এই জোটের প্রধান শরিক দল বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কাজ চূড়ান্ত এবং দেশব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে শারদীয় দুর্গাপূজার পর ধারাবাহিক কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকরা। প্রয়োজনে সরকারকে সময় বেঁধে দিয়ে শিগগির ঘোষণা করা হবে ‘আন্দোলন এবং নির্বাচনে’র রোডম্যাপ। বিদেশি কূটনীতিক ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি বৈঠক করার পরিকল্পনাও করেছে নতুন এই জোট। সেখানে জোটের ‘৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্যে’র প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হবে।

এদিকে তিন রাজনৈতিক দলের যুক্তফ্রন্টের কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এ জোটের দুই রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হলেও অপর দল বিকল্পধারা এর বাইরে রয়েছে। এ অবস্থায় এ জোট তার কার্যকারিতা হারিয়েছে বলে মনে করছেন অন্য দুই শরিক দলের নেতারা।

এ বিষয়ে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এই জোট গঠনের উদ্দেশ্য থেকে বিকল্পধারা সরে গেছে। তার দল নাগরিক ঐক্য ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি এবং সম্প্রতি যুক্তফ্রন্টে যোগ দেওয়া সোনার বাংলা পার্টি এবং বাংলাদেশ জনদল ঘোষিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়েছে। সুতরাং একটি মাত্র দল (বিকল্পধারা) থাকায় এই যুক্তফ্রন্টের কার্যকারিতা নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, পূজার পর আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। দাবি-দাওয়ার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সারাদেশে ছুটে বেড়াবেন তারা।

আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্ট বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। এরপর বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’র রূপরেখা চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তবে এ-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই গত শনিবার এতে ফাটল ধরে। নির্ধারিত বৈঠক না হওয়ার পর দু’জনের পক্ষ থেকেই সেদিন সন্ধ্যায় আলাদা সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। এতে একদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন। বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে নিয়ে এই নতুন জোট গঠিত হয়। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্য নয় বলে ঘোষণা দেন বি. চৌধুরী। এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত দেয় বিকল্পধারা বাংলাদেশ। প্রথমত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী এমন সব দল বা ব্যক্তির সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, ক্ষমতায় বা জোটে ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলটি সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে দেড়শ’ আসন দিয়ে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে দেড়শ’ আসন দেওয়ার দাবি করে।

বিকল্পধারার নেতাকর্মীরা জানান, তিনটি রাজনৈতিক দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পর আন্দোলনে সাংগঠনিক শক্তিমত্তা ও সক্ষমতার জন্য বিএনপির সঙ্গেও ঐক্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দলের একটি অংশ শুরু থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছিল। এই বিরোধিতার অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে বিএনপিকে দূরে সরিয়ে রাখার পরিকল্পনা নেয়। অন্যরা এতে দ্বিমত জানালেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। উল্টো দলের নেতাদের বহিস্কার করা হয়।

বিকল্পধারার বেশ কয়েকটি সভায় সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়েও আলোচনা করেন সংশ্নিষ্ট নেতারা। তারা জানান, দলের সাংগঠনিক অবস্থা এতই দুর্বল যে, দলের চেয়ারম্যান বি চৌধুরীর নিজের জেলা মুন্সীগঞ্জ এবং তার নিজ নির্বাচনী আসনে পর্যন্ত কোনো কমিটি নেই। মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের নিজের জেলা লক্ষ্মীপুরেও কোনো কমিটি নেই। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৭১ জন সদস্যের নাম থাকলেও কার্যত সক্রিয় রয়েছেন ২৫-২৬ জন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই দলত্যাগ করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন- বিকল্পধারার কেন্দ্রীয় সমবায়বিষয়ক সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বাবুল, যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক খন্দকার জোবায়ের, কৃষকধারার আহ্বায়ক চাষী এনামুল, প্রচার সম্পাদক প্রকৌশলী জুন্নু প্রমুখ।

তাদের অনেকেই সমকালকে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলের প্রেসিডেন্ট বি চৌধুরীর নয়। এটা তার ছেলে মাহী বি. চৌধুরীর ইচ্ছাপূরণের সিদ্ধান্ত। তারা এই সিদ্ধান্তকে ‘গণবিরোধী’ মনে করছেন। কারণ মানুষ চেয়েছিল, দেশে জাতীয় ঐক্য হোক। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য মাহী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এসব বিষয়ে মাহী বি. চৌধুরী সমকালকে বলেন, বিকল্পধারা ঐক্যবদ্ধ আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তার বিরুদ্ধে দলের ভেতর একক স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দলের সাবেক সহসভাপতি শাহ আহমেদ বাদল জানান, শুরু থেকেই তিনি বিকল্পধারার সঙ্গে আছেন। এই দলের কর্ণধার হিসেবে পরিচিত মাহী বি. চৌধুরীর অসাংগঠনিক সিদ্ধান্তে ইতিমধ্যেই অনেক গুণীজন দল ত্যাগ করেছেন। অনেককে বহিস্কার করা হয়েছে। এভাবে রাজনীতি চলতে পারে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দু-একদিনের মধ্যে তলবি সভা ডেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করবেন।

দলের কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাজমুল হক পিন্টু জানান, সারাদেশে দলের সাংগঠনিক অবস্থা বেশ ভঙ্গুর। অথচ দলকে সংগঠিত না করে, জাতীয় প্রত্যাশা পূরণ না করে দলকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। তাই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন।

এ বিভাগের অন্যান্য