জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নেই বিকল্পধারা ২০ দলে স্বস্তি
সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনের ফলে ‘স্বস্তি’বোধ করছেন ২০ দলীয় জোটের শরিকরা। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এতে সন্তুষ্ট। শুরু থেকে বিকল্পধারা নানা শর্ত দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন শরিক দলগুলোসহ বিএনপি নেতাকর্মীরা। বি. চৌধুরী দীর্ঘদিন জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে জোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পর তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অতিমাত্রায় চাপাচাপি করায় অসন্তুষ্ট ছিলেন তারা। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই বছর ঐক্যজোটকে ক্ষমতায় রাখা এবং জোটকে দেড়শ’ আসন দেওয়ার শর্তারোপকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেন শরিক দলগুলোর নেতারা।
জোটের সূত্র জানায়, বিকল্পধারার নানা শর্ত জুড়ে দেওয়ার এমন মনোভাবকে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন জোট ও বিএনপি নেতাকর্মীরা। ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি আরেকটি জোট গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রথম দিকে অস্বস্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারাকে বাদ দেওয়ায় কিছুটা স্বস্তিবোধ করছেন তারা। নতুন জোটের শুভকামনা করেন তারা। পাশাপাশি জোটের সামনে বড় দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন। চ্যালেঞ্জ দুটির একটি হচ্ছে- ২০ দলীয় জোটের শরিক ১৯ দল এবং নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক তিন দলের মধ্যে সমন্বয় করে নির্বাচনে আসন বণ্টন; অন্যটি হচ্ছে, নানামুখী চাপের মধ্যে ঐক্য সংহত রাখা।
এদিকে নতুন জোট গঠনে বি. চৌধুরীর শর্তারোপে ক্ষুব্ধ ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের মান ভাঙাতে গতকাল রাতে তার মহাখালীর পুরনো ডিওএইচএসের বাসভবনে যান বিএনপির সিনিয়র নেতারা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে জোটের কোনো শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেননি অলি আহমদ। একই সঙ্গে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে জোট গঠনে বি. চৌধুরীর শর্তারোপের কঠোর সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বাদ দিয়ে বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় অলি আহমদ কিছুটা ‘নরম’ হয়েছেন। তাকে জোটের রাজনীতিকে সক্রিয় করতে গত রাতে তার বাসায় যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান। এ বিষয়ে এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম গতকাল সমকালকে বলেন, বিকল্পধারা নিয়ে অলি আহমদের স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য অনেকেই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বিএনপির শীর্ষ নেতারাও অলি আহমদের পূর্বের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর না থাকা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রোববার বলেছেন, জোট গড়ার বৈঠকগুলোতে কিছু বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে সমস্যা তৈরি করছিল বিকল্পধারা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের বাদ দেওয়ার জন্য কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই জোটে আসেনি। আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, কতকগুলো বিষয়ে অযথা চাপ তৈরি করে একটা সমস্যা তৈরি করা হয়েছে। তবে আশা করি, তারা ঐক্যে ফিরে আসবেন। বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী গতকাল বলেছেন, তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছিলেন। বাকি দলগুলো আপস করেছে, তারা করেননি।
বি. চৌধুরীর বিকল্পধারাকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ গতকাল সমকালকে বলেন, প্রথমে যে ভুল হয়েছিল, সেটা আংশিক সংশোধন হয়েছে। তিনি আরও মনে করেন, এ জোটের পেছনে যে সময় বিএনপি ব্যয় করেছে, তা দল ও ২০ দলীয় জোটের পেছনে করলেই বরং ভালো হতো; দল ও জোট আরও উজ্জীবিত হতো। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পথচলা বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন অলি আহমদ।
জোটের নেতারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী সব দলকে নিয়ে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়ার উদ্যোগে বি. চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে পাশে চেয়েছিল নানামুখী চাপে থাকা বিএনপি। দুই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারারুদ্ধ হওয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও সাজা মাথায় নিয়ে নির্বাসনে থাকা এবং নেতাকর্মীদের মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে জর্জরিত দলটি ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল। জোট নেতাদের মতে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের এই শূন্যতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে যেন ‘দিবাস্বপ্ন’ দেখতে শুরু করে বিকল্পধারা। নানা শর্ত দিয়ে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করে আবার বঙ্গভবনে যাওয়ার ‘স্বপ্ন’ দেখছিলেন বি. চৌধুরী ও তার ছেলে মাহী বি. চৌধুরী।
জোট নেতাদের মতে, এখন আর জটিলতা হবে না। ঐক্যফ্রন্টে এখন যারা আছেন, তারা বাস্তববাদী। বাস্তবতার সঙ্গে তাদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গতি থাকবে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীই তারা দেবেন। মনোনয়ন এবং জামায়াতকে নিয়েও কোনো সমস্যা হবে না। আবার জামায়াতের বিতর্কিত নেতাদেরও মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
নাম প্রকাশ না করে জোটের কয়েকজন নেতা জানান, একটি বৃহৎ জোট থাকার পর আবারও নতুন করে বিকল্পধারা, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বিএনপির জোট গঠনের উদ্যোগকে ভালোভাবে দেখেনি ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ দল। বিশেষ করে এলডিপিসহ সাত-আটটি দল ঐক্যের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলে আসছে। নিজেদের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দেশ ও গণতন্ত্রের বৃহৎ স্বার্থে ঐক্য প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে যান তারা।
জোট নেতারা জানান, বিশেষ করে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর তৎপরতায় তারা অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। তারা এখন স্বস্তিবোধ করছেন। সারাদেশে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী নেই, তার পরও বিকল্পধারার দেড়শ’ আসন চাওয়া হাস্যকর। জোটের অনেক নেতা ঘরোয়া বৈঠকে সমালোচনা করলেও প্রকাশ্যে করতেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তার এই খোলামেলা বক্তব্য ও ভূমিকায় ধন্যবাদ জানান জোটের শরিক অনেক নেতা।
জোটের আরেক নেতা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম গতকাল সমকালকে বলেন, আমরা ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে জাতীয় ঐক্য গড়ার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছি। কারণ, ২০ দল সবাইকে নিয়ে জোট করলে নানা সমস্যা হতে পারে, সে জন্য আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান দল বিএনপিকেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে পাঠানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দলের সমর্থক, নেতাকর্মী এবং নির্বাচনে প্রার্থী বিএনপির বেশি হবে বলে তারাই উভয় জোটে প্রধান শরিক হিসেবে নেতৃত্ব দেবে। বিএনপিকে কৌশলী হয়ে সময়োপযোগী ভূমিকা নিতে হবে।
বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ সমকালকে জানান, তারা নতুন জোটকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। সবাই মিলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি। বি. চৌধুরীকে জোটে না রাখার প্রসঙ্গে বলেন, তিনি যুক্ত হতে পাে রননি- এটা দুঃখজনক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, নতুন জোট হওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ; বিএনপি নয়।
নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি :রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের মতে, বিএনপি এবং বি চৌধুরীর বিকল্পধারার মধ্যে সবসময়ই আস্থার অভাব ছিল। আপাতত বি. চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ফলে চ্যালেঞ্জ বাড়ল না কমল, তা সময়ই বলে দেবে। বিশেষ করে আসন বণ্টন হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের আসন ছেড়ে দেওয়া বিএনপির জন্য কঠিন হতে পারে। বিশ্নেষকরা আরও বলেন, শুধু আসন বণ্টন নয়, ঐক্য ধরে রাখাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ ঐক্য নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেওয়ার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন দল চাইবে না, কোনো শক্তিশালী জোট নিয়ে বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচন করুক। কাজেই নানামুখী চাপ সামাল দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো বাস্তবিকই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে বিএনপির জন্য।
এদিকে মাহী বি. চৌধুরী এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার একটি টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফোনালাপটি ভাইরাল হয়েছে। সেখানেও মাহী বি. চৌধুরী নতুন ফ্রন্টের পেছনে ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিকল্পধারার কারণে তাদের ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হচ্ছিল। বিকল্পধারাকে নিয়ে ২০ দলীয় জোট ও বিএনপিতে অস্বস্তি বিরাজ করছিল। এই দুই দলের মধ্যে সন্দেহ বা আস্থার অভাবের কথাও আসছে। মাহী বি. চৌধুরী এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনেক পুরনো দ্বন্দ্ব রয়েছে। সেটিও অন্যতম কারণ হতে পারে এখনকার পরিস্থিতির জন্য।
অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্নেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেছেন, নতুন জোটের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেও এমন পরিস্থিতি হতে পারে। তিনি বলেন, আমার যেটা ধারণা, ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে ড. কামাল হোসেন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই ছিল। সেটার জেরে বিষয়টা এতদূর এসে পৌঁছেছে।