সিলেট-২ আসনে ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পার্টি
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা এবং তিনটি ইউনিয়ন বাদে বালাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে সিলেট-২ আসনে মনোনয়ন লড়াই শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একক প্রার্থী নিয়ে মাঠে থাকলেও আ’লীগ দুই চৌধুরীসহ তিন প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই বেকায়দায়। ভোট সামনে রেখে আ’লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মনোনয়নপ্রত্যাশী দুই চৌধুরীকে ঘিরে বিভক্ত আ’লীগ।
সাবেক এমপি জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আ’লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী একে অন্যের ছায়া পর্যন্ত মাড়ান না। কর্মীরা বলছে, এই দ্বন্দ্বের জেরে দুর্বল হয়ে পড়ছে আ’লীগ। এ পরিস্থিতি ভোটের দিন পর্যন্ত গড়ালে তা ভোটের মাঠেও প্রভাব পড়বে বলে ধারণা অনেকের। স্বতন্ত্র হলেও ভোটের লড়াইয়ে নামার জন্য প্রস্তুত সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা আ’লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমানের ভাগ্নে অধ্যক্ষ এনামুল হক সরদার।
বিভক্তিসহ মামলা-হামলায় ছন্নছাড়া বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা প্লাটফর্মে অবস্থান নিলেও নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনাকে নিয়ে তারা জোটবদ্ধ। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, লুনার জন্য সাত খুন মাফ। এ আসনের ভোটাররাও ইলিয়াস প্রশ্নে বেশ আবেগতাড়িত। ফলে এ আসনে ‘বৌমা’ লুনা প্রার্থী হলে ভোট বিপ্লব ঘটবে দাবি স্থানীয় বিএনপি ছাড়াও সমমনা দলের নেতাদের। জানা গেছে, প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত লুনাও।
অপরদিকে এ আসনের বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির নেতা ইয়াহইয়া চৌধুরী নির্বাচনের ব্যাপারে এবারও অনড়। জাতীয় পার্টির এই কেন্দ্রীয় নেতা আসনটি কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ। তিনি পুরোপুরি মাঠে নেমে পড়েছেন মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে। দলবল নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে সিলেট-২ আসনে ভোটের সমীকরণ জটিল হয়ে পড়েছে।
গত ৯ম ও ১০ম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আ’লীগের শফিকুর রহমান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমানের কোন্দল ছিল তুঙ্গে। উভয়ই ছিলেন মনোনয়নের জন্য মরিয়া। ৯ম সংসদ নির্বাচনে শফিকুর রহমান চৌধুরী মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলেও বঞ্চিত হন মুহিবুর। দশম সংসদ নির্বাচনে ফের শফিক-মুহিবুর মনোনয়ন যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও দু’জনই বঞ্চিত হন। আসনটি চলে যায় জাতীয় পার্টির কব্জায়। এমপি হন জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া। ওই নির্বাচনে আ’লীগের মুহিবুর রহমান প্রার্থী হলেও পরাজিত হন। মুহিবুর বলয়ের অভিযোগ ছিল, শফিকুর রহমান নির্বাচনে ইয়াহ্ইয়া চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যায় রাজনীতির চিত্র। এখন ইয়াহ্য়ার সঙ্গে সেই দূরত্ব নেই প্রতিদ্বন্দ্বী মুহিবুরের। ইয়াহইয়ার সঙ্গে আনোয়ারুজ্জামানেরও গলায় গলায় ভাব। ১৯৯১ সালে এ আসনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির মকসুদ ইবনে আজিজ, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হন আ’লীগের মুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজুর রহমান, পরের বছর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস আলী, ২০০৮ সালে শফিকুর রহমান এক লাখ ৯ হাজার ৩৫৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, এক লাখ ৬ হাজার ৮০ ভোট পেয়ে পরাজিত হন ইলিয়াস আলী।
মাঠের তৎপরতার কারণে দলের নেতাকর্মীদের কাছে শফিকুর রহমান ‘চব্বিশ ঘণ্টার রাজনীতিক’ বলে পরিচিত। বিষয়টি মাথায় রেখে আনোয়ারুজ্জামান এখন সিলেটেই সময় দেন বেশি। লন্ডন ৩ দিন থাকলেও সিলেটে থাকেন ৩ মাস। অবস্থা অনেকটা এমন- ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।’
মনোনয়নের ব্যাপারে শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করি। নৌকা আমাদের প্রতীক, নেত্রী আমাদের শেখ হাসিনা। দেশের কল্যাণে দলের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছি। কে মনোনয়ন পাবেন, কে পাবেন না এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এটা দলীয় প্রধানের বিষয়। তবে আমি মনোনয়নপ্রত্যাশী। অতীত-বর্তমান বিবেচনা করে নেত্রী ও দল যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই শেষ কথা। ২০০৮ সালের ভোটে বিএনপির ইলিয়াস আলীকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হই এবং ব্যাপক উন্নয়ন করি। কিন্তু জোটের স্বার্থে ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। তবে একটা কথা বলা জরুরি- দলে যারা ব্যক্তি প্রতিহিংসা ও মনোনয়নের লোভে নানা অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র ও কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন তা ঠিক নয়।
জানতে চাইলে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সিলেট-২ আসনে নৌকার মনোনয়ন আমিই পাব এবং বিজয়ী হব। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গেই রয়েছেন। মনোনয়ন পেলেও শফিকুর রহমান বলয়ের ভোট পাবেন কিনা এমন প্রশ্নে আনোয়ারুজ্জামান বলেন, এ দ্বন্দ্ব আদর্শিক নয়। নৌকা মানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা। যারা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রাজনীতি করেন তারা নৌকার বিরোধিতা করবেন না। শফিকুর রহমান মনোনয়ন পেলে কি করবেন? জবাবে আনোয়ার বলেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে নৌকা, যিনি নৌকা নিয়ে আসবেন তার পক্ষেই কাজ করব।
অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদার বলেন, এ আসনে অনেকেই এমপি হয়েছেন কিন্তু এলাকার মানুষের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি। হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ের জন্য কেউ কিছু করেনি। কিছু পাওয়ার জন্য নয়, দেয়ার জন্যই নির্বাচন করতে চাই। বেশি কিছু করতে না পারলেও অন্তত পথ দেখাতে চাই।
আগামী নির্বাচনে আসনটি ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব বর্তমান এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী বিভিন্ন জনসভায় বলছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন, এ আসনে তিনিই মনোনয়ন পাবেন। তবে সেটা জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে। কথা হয় এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জোটগত নির্বাচন হলে এ আসনে আমার মনোনয়ন শতভাগ নিশ্চিত। তা না হলে এককভাবে নির্বাচন করব। মহাজোট যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা হয়তো মেনে নিতে হতেও পারে।
এ আসনে বিএনপিতে বিভক্তি স্পষ্ট। তবে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনার পেছনে একাট্টা স্থানীয় বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা লুনা ঢাকায় থাকলেও মাঠের নেতারা তার নিয়ন্ত্রণে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগও রয়েছে তার। প্রতীক, দল, মত ও আদর্শের বিভক্তি লুনার বেলায় নেই। লুনা নির্বাচন করলে সিলেট-২ আসনে ভোট বিপ্লব ঘটবে।
জানতে চাইলে ইয়িলাসপত্নী তাহসিনা রুশদী লুনা বলেন, ভোটের তোড়জোড় লক্ষ্য করা গেলেও সবশেষ বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তবে মনোনয়ন ও বিজয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। জোটগতভাবে নির্বাচন হলেও মনোনয়ন আমারই থাকবে। তিনি বলেন, আমার এলাকার মানুষ তাদের নেতা ইলিয়াস আলীকে কতটুকু ভালোবাসেন তা ভোট না হলে কাউকে বোঝানো যাবে না।
কেন্দ্রীয় খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুনতাসির আলীও এখন মাঠে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। মুনতাসির আলী বলেন, জোটগত নির্বাচন হলেও এই আসনের মনোনয়ন আমিই পাব। না হলে এককভাবে খেলাফত মজলিস নির্বাচন করবে।