একক নয়, যৌথ নেতৃত্ব

এ মাসেই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আত্মপ্রকাশ

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চলতি মাসেই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্ট, গণফোরাম ও কয়েকটি বাম দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলতে চলেছে বিএনপি। তবে এ জোটে কোনো একক শীর্ষ নেতৃত্ব থাকছে না, এটি পরিচালিত হবে যৌথ নেতৃত্বে। একক নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই বলেও জানিয়েছেন বিএনপি ও বৃহত্তর ঐক্য গঠনে উদ্যোগী নেতারা।

জোট গঠনে সক্রিয় নেতারা জানাচ্ছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো এবারের আন্দোলনও দলগত ও জোটগত নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন- কেউই এককভাবে শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো পদে থাকছেন না। তবে যে কোনো সভা-সমাবেশে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী প্রধান অতিথি ও সভাপতিত্ব করবেন তারা। এরই মধ্যে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের মধ্যে সৃষ্ট টানাপড়েনও খানিকটা কমে এসেছে। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা গতকাল সন্ধ্যায় ড. কামালকে টেলিফোন করে জানিয়েছেন, আগামীকাল শনিবারের ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে যোগ দেবেন।

এ বিষয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনও গত বৃহস্পতিবার  বলেন, তিনি কখনও একক নেতৃত্বে বিশ্বাসী নন। তা ছাড়া বৃহত্তর জোটে একক নেতৃত্বের প্রয়োজনও নেই। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে কোনো টানাপড়েন নেই দাবি করে ড. কামাল বলেন, তিনি (বি. চৌধুরী) অসুস্থতার কারণে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসতে পারেননি। তিনি (বি. চৌধুরী) আজ (বৃহস্পতিবার) তাকে টেলিফোন করে শনিবারের সমাবেশে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর  বলেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় একক নেতৃত্বের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বুধবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। তা ছাড়া একক নেতৃত্বের প্রয়োজনও নেই। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে দল ও জোটগতভাবে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করবেন নেতারা।

একই মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও। গতকাল তিনি  বলেন, বৃহত্তর ঐক্য জোটে একক নেতৃত্বের কোনো সুযোগ নেই। অতীতেও জোটভিত্তিক আন্দোলনে একক নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়নি। এরশাদবিরোধী আট দল, সাত দল, পাঁচ দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলনকারীদের মধ্যে কোনো একক নেতৃত্ব ছিল না।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব গতকাল  বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তারা একত্র হয়েছেন। এখন তারা কর্মসূচির ভিত্তিতে অন্যান্য দলকে নিয়ে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছেন। একক নেতৃত্বের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শনিবারের সমাবেশের পর নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না  বলেন, যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই আপাতত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হচ্ছে। বিএনপি কার নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গড়তে চায় বা না চায়, সেটা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব বিষয়। তাদের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন রয়েছেন। শনিবারের নাগরিক সমাবেশে তারা যোগ দেবেন। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসনের জন্য বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। হয়তো এ মাসেই তা চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।

জোটের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বর্তমানে কারারুদ্ধ থাকায় তার অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে বৃহত্তর ঐক্যের শীর্ষ নেতা করা হবে না। যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হবে ঐক্যজোট। বিশেষ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বৃহত্তর ঐক্যজোটে থাকলে সেখানে অন্য কাউকে শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সম্প্রতি খুলনায় জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশেও বি চৌধুরীকে প্রধান অতিথি এবং ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে অসুস্থতার কারণে বদরুদ্দোজা চৌধুরী খুলনায় যেতে পারেননি।

সূত্র মতে, ভবিষ্যতেও প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে বি চৌধুরী ঐক্য জোটে থাকলে তাকেই যথাযথ সম্মানের সঙ্গে রাখা হবে। ড. কামালকে তার উপরে কোনো পদে বসানো হবে না। একইসঙ্গে বিএনপির মতো বড় দলের বাইরে ছোট দলের কাউকে জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের পদ দেওয়ার ব্যাপারটি মানতে রাজি নন দলটির অনেক নেতা। তবে শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠন হলে একটি ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ গঠন করা হবে। ওই কমিটি বিভিন্ন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেবে। একইসঙ্গে দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে একজন সিনিয়র নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হবে।

আগামী একাদশ সংসদ তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা ও নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের অভিন্ন দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে চলেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও মহাজোটের বাইরে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে বা একই প্ল্যাটফর্মে বিএনপি, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্টে থাকা বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য এবং বাম গণতান্ত্রিক ধারার পৃথক চারটি দল ছাড়াও আট দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকেও নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ঘোষণা করা হয়েছে। আগামীকাল শনিবার হবে নাগরিক সমাবেশ। রাজধানীতে সরকারবিরোধী এসব রাজনৈতিক দলের এটাই প্রথম কর্মসূচি। এই কর্মসূচিকে সফল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমাবেশের জন্য লিখিত অনুমতি পাওয়া গেছে। পোস্টার আর লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিও করছেন সংশ্নিষ্ট নেতাকর্মীরা।

এ পরিস্থিতিতেও সংশয় প্রকাশ করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ঘোষণার স্পিরিট হয়তো তাদের প্রথম সমাবেশে প্রতিফলিত হবে না। ড. কামাল হোসেনের ডাক দেওয়া এই সমাবেশে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও বাম জোটের নেতারা অংশ নেবেন। এর পাশাপাশি সীমিত পর্যায়ের নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। তবে সব কিছু মিলিয়ে সমাবেশ সফল করতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন নেতারা।

সূত্র জানাচ্ছে, বিএনপি বাম জোট নেতাদের সঙ্গেও বৈঠকের পর বৈঠক করছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী নেতারা আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করছেন। এর মধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অন্যতম। তিনি যুক্তফ্রন্টের তিন রাজনৈতিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের নেতাদের নিয়ে ম্যারাথন বৈঠক করছেন। গতকাল দুপুরে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বারিধারার বাসভবনে বৈঠক করেছেন আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না। এ বৈঠকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করার পাশাপাশি শনিবারের সমাবেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডন থেকে ফেরার পর গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দু’দিন বৈঠক করেছেন। গত বুধবার ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি। এসব বৈঠক থেকে শুধু সমাবেশ সফল করার জন্য নয়, একাদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণে নিশ্চিত করতে একমত পোষণ করেছেন নেতারা। একই সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্যসহ নানাবিধ লক্ষ্য নিয়েও তারা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ সরকারবিরোধী শিবিরে থাকা বাম প্রগতিশীল ঘরানার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদেরও ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে নাগরিক সমাবেশে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই সমাবেশ থেকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে অভিন্ন দাবি ঘোষণারও কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ড. কামাল হোসেন এ ঘোষণা দেবেন।

অবশ্য শনিবারের সমাবেশ থেকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে না। তবে চলতি মাসের মধ্যেই ঐক্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন নেতারা। অভিন্ন ইস্যুতে অক্টোবরের শুরুতে যুগপৎ আন্দোলন এবং মাঝামাঝিতে একই মঞ্চ থেকে কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা রয়েছে।

সমাবেশের বিষয়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন বলেন, ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চের সমাবেশে লোক সমাগমের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখনও সমাবেশের জায়গা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। অনেকে এখনও মনে করছেন তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের আয়োজন করেছেন। ছোট রাজনৈতিক দলের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব অকপটে স্বীকার করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, এই সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য ড. কামাল হোসেন সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবীসহ বিশিষ্ট নাগরিকদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন তাদের এই সমাবেশ রাজনৈতিক ঐক্যপ্রচেষ্টা নয়, এটা সামাজিক ঐক্য প্রক্রিয়া।

এ বিভাগের অন্যান্য