মৌলভীবাজার-২ আসনে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল। আগামী জাতীয় সংসদ নিবার্চনকে সামনে রেখে কী আছে কুলাউড়া উপজেলাবাসীর ভাগ্যে? এমন সব আশা প্রত্যাশা দানা বাঁধছে শুধুমাত্র কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদীয় এলাকায়। জাতীয় রাজনীতিতে উপেক্ষিত ও কুলাউড়া নামক উপজেলার তৃণমূলের মানুষ দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নানা বঞ্চনায় শিকার হয়ে আসছে। এর থেকে মুক্তি চাইলে পরিবেশ পরিস্থিতিতে আর রাজনীতির কূট-কৌশলে তৃণমূলের আশা আকাঙ্খা বিফলে গেছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবারে ঘুরে দাঁড়াতে চায় এ এলাকার সাধারণ মানুষ। তবে সেটা অনেকটা নির্ভর করছে দেশের সর্ববৃহৎ দুটি দলের প্রার্থী বাছাইয়ের উপর। জোট মহোজোটে একক নাকি তাদের শরিক দলের প্রার্থী মৌলভীবাজার-২ আসনের জন্য নির্ধারণ করছেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। কিন্তু এবারে অনেকটা প্রার্থী বাছাইয়ের উপর অধিক দলের জয় পরাজয়। সম্প্রতি কমলগঞ্জ উপজেলার চা বাগান অধ্যুষিত চারটি ইউনিয়ন মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে বাদ দেয়ার ফলে প্রভাব পড়তে পারে ক্ষমতাসীনদল আ.লীগের নির্বাচনী মাঠে। তবে শরিকদল সুযোগ নিতে চাইলে ছাড় দিবে না দেশের বৃহৎ আরেকটি রাজনৈতিক দল বিএনপি।
কোন দলেরই এ আসনে একক আধিপত্য না থাকলেও নব্বই পরবর্তী ছয়টি সংসদ নির্বাচনে দুই বার লাঙ্গল, দুইবার স্বতন্ত্র একবার করে নৌকা ও ধানের শীষ জয়লাভ করে। ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনটি সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেননি কিংবা মনোনয়ন পননি। ২০০১ সালে বিএনপির বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এম শাহীন, ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী নওয়াব আলী আব্বাস খান এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আব্দুল মতিন এমপি নির্বাচিত হন। অর্থাৎ দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও একজন জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করলেও আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কোনো প্রার্থী এ তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি। শুধু তা-ই নয়; এর কারণ হিসেবে ভোটাররা অবশ্য দুই দলের প্রার্থী মনোনয়নকে দায়ী করেছেন।
বিগত ৩০ বছরের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই আসনে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এসেও জামানত হারিয়েছেন। গত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাছ খান ৩য় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রার্থী ছিলেন বিএনপি থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএম শাহীন। অপর প্রার্থী অ্যাডভোকেট এএনএম আবেদ রাজা বিএনপির ধানের শীষ প্রতিক নিয়ে ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান শামীম আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জামানত হারান।
এই আসনের প্রত্যেক ভোটের ফলাফলে চা শ্রমিকরা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। কুলাউড়া উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়নে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি চা শ্রমিকদের ভোট। নির্বাচনে তাদের কদর বাড়ে দ্বিগুণ। বিগত দেড় যুগ ধরে এই আসনে দলীয় প্রার্থীরা জয়ী হতে পারছেন না। এই নৃ-গোষ্ঠীর ভোট নিজেদের ভোট ব্যাংক হিসেবে দেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
এই আসনকে ঘিরে মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে চলে ব্যাপক আলোচনা। কারণ এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তিন প্রধান দলেরই জনপ্রিয় নেতারা রয়েছেন স্রোতের বাইরে। এদের মধ্যে আ.লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ আলোচনায় থাকলেও তিনি আ.লীগ থেকে নির্বাসিত। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রচারনা চালাচ্ছেন আ.লীগের প্রায় হাফ ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী।
১৯৯৬ সালে দলীয় নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বিগত ওয়ান ইলেভেন প্রেক্ষাপট থেকেই দলে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছেন। ২০০১ সালে ডাকসুর সাবেক এই ভিপিকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচিত হয়েছিলেন এমএম শাহীন। জোট সরকারের শেষের দিকে স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এসে কুলাউড়ায় শাহীনকে দলে নিলেও ওয়ান ইলেভেনের বিতর্কিত ভূমিকায় হতাশ বিএনপি নেতাকর্মীরা তাকেও দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যদিও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করেন।
বড় দুই দল ছাড়া বিএনপির শরীক দল জামায়াতের কোন অবস্থানই লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচনের ব্যাপারেও তাদের কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছেনা। যদিও জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের বাড়ি কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে। বিগত ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি ৪ দলীয় জোট থেকে নির্বাচন করে ৪র্থ স্থানে অবস্থান করেন।
আওয়ামীলীগ
এদিকে বর্তমান এমপি আব্দুল মতিন ছাড়াও আ.লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী অপর নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক জনপ্রিয় এমপি মরহুম আব্দুল জব্বারের ছেলে কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আসম কামরুল ইসলাম, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সাংবাদিক কামাল হাসান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও সিলেট মহানগর আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, বিএমএর সিলেট বিভাগীয় সভাপতি ডা. রুকন উদ্দিন আহমদ, ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আ.লীগের মনোনয়নপ্রাপ্ত অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান শামীম, পুলিশের সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুল করিম, মৌলভীবাজার জেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি সৈয়দ মফচ্ছিল আলী।
বিএনপি
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির বর্তমান সহ-সভাপতি এবং ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও এ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক দুই বারের এমপি এমএম শাহীন, সাবেক পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন আহমদ জুনেদ।
শরিক দল
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আ.লীগ ও বিএনপির শরিক দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে নিবার্চন করতে পারেন এমন প্রার্থীও রয়েছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট আর আওয়মীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে উভয় জোটে এই আসনে শরিক দল বলতে জাতীয় পার্টিকেই হিসাবে নেয়া হচ্ছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে এরশাদের জাতীয় পার্টি আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি উভয় গ্রুপ থেকে এই আসনে প্রার্থী রয়েছেন।
জাতীয় পার্টি এরশাদের প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য অ্যাড. মাহবুবুল আলম শামীম। অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় সদস্য আহমেদ রিয়াজ ও মুহিবুল কাদির চৌধুরী পিন্টু। অপরদিকে জাতীয় পার্টি কাজী জাফর গ্রুপের একমাত্র মনোনয়ন প্রত্যাশী এই আসনের সাবেক তিন বারের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাস খান। তবে দৃশ্যত তিনি কাজী জাফর গ্রুপের প্রার্থী হলেও সম্প্রতি তিনি এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে লবিং করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হতে পারেন জামায়াতের কেন্দ্রিয় সেক্রেটারী জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান।
আ.লীগ বিএনপি উভয় দল মরিয়া নিজ দলীয় প্রার্থী ও প্রতীকে নির্বাচন করে আসন পুনরুদ্ধারে আর শরিকরা মরিয়া এই আসন থেকে মনোনয়ন পেতে। অপরদিকে তিনশ আসনের মধ্য থেকে যে যে আসন শরিকদের ছেড়ে দিয়ে জোট এবং মহাজোট গঠন করবে বিএনপি ও আ.লীগ তার মধ্যে এই আসনটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত জানা গেছে।
কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-২ নির্বাচনী আসনে জোট ও মহাজোটে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ নিজ দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিবে না শরিকদের ছেড়ে দিবে এ নিয়ে সাধারণ জনগনের মধ্যে কৌতুহলের শেষ নেই, চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। অপরদিকে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা রয়েছেন কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত।
এ বিভাগের অন্যান্য