আ.লীগে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মানিক, বিএনপিতে লড়াই তিনজনের

 

সুনামগঞ্জ জেলার শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত ছাতক ও দোয়ারাবাজার নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৫ আসন। এই আসনে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে রয়েছে চরম দ্বন্দ্ব। তবে এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মুহিবুর রহমান মানিক দলের তৃণমূলে বেশ জনপ্রিয়। দলের জেলা শাখার সহসভাপতি মানিক তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আওয়ামী লীগে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে ক্ষমতাসীন দলের আরো কয়েকজন নেতা মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করছেন তিন শক্তিশালী সম্ভাব্য প্রার্থী। তাঁরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, ছাতক উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দলের কেন্দ্রীয় নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী ও শিল্পপতি প্রকৌশলী মুনসেফ আলী। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এর আগে এই আসনে কয়েকবার বিজয়ী হয়েছে। দলের দুজন নেতা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

আওয়ামী লীগ : দলের নেতাকর্মীরা জানায়, মুহিবুর রহমান মানিক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রগতিকামী নেতা। তিনি জামায়াত-শিবিরবিরোধী। জাতীয় নির্বাচনে টানা ছয়বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। নবম জাতীয় নির্বাচনে সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে তিনি লক্ষাধিক ভোট বেশি পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে নির্বিরোধ এই নেতা ১৯৯১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে টানা মনোনয়ন পাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে প্রথম বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর থেকে মুহিবুর রহমান মানিক দলীয় কোন্দলের শিকার। তাঁর বাসায় নিজ দলের প্রতিপক্ষ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ আছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর মানিক জেল খাটেন। তবে অধিকতর তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় কোন্দলের কারণে নিজ দলের প্রতিপক্ষের পরোক্ষ সহযোগিতায় বিএনপি ছাতক উপজেলার বেশির ভাগ কেন্দ্র দখল করে তাঁর বিজয় ছিনিয়ে নেয় বলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের অভিযোগ। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে টানা দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও তাঁর কর্মী-সমর্থকরা দলীয় প্রতিপক্ষের হাতে মার খাচ্ছে—এমন অভিযোগও আছে। সম্প্রতি তাঁর ভাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেনকে কয়েকবার মারধর করেছে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজন।

অভিযোগ রয়েছে, সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক ও তাঁর সমর্থকদের কোণঠাসা করতে দলে তাঁর বিরোধী পক্ষ এই এলাকায় শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত জামায়াত-শিবিরেরও সহায়তা নিয়ে থাকে।

আশির দশকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে চমক দেখান মুহিবুর রহমান মানিক। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সবাই জামানত হারিয়েছিলেন। এরপর তিনি সংসদ নির্বাচন করে জাতীয় পার্টির কাছ থেকে আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দেন। একজন সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ জননেতা হিসেবে তিনি তৃণমূলে বিশেষ সমাদৃত। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ সংগঠকও তিনি।

নেতাকর্মীরা জানায়, তৃণমূলের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় সংসদ সদস্য মানিক কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনবার সংসদ সদস্য থাকার সুবাদে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় রাস্তাঘাট, কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন। সুরমা নদীর ওপর সেতু অনুমোদন করিয়ে এখন তিনি আরো বেশি আলোচিত।

জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৬ সালে কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করেই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য এটা করলেও সেতুর কাজ আর এগোয়নি। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) এই সেতু প্রকল্প অনুমোদন করিয়েছেন মুহিবুর রহমান মানিক। সেতুটি নির্মিত হলে সরাসরি দোয়ারাবাজার উপজেলাবাসী সিলেট ও ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে। এতে ছাতকের সঙ্গেও উপজেলাটির সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ছাতক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবু সাদাত লাহিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় তিনবার নির্বাচিত হয়ে বিপুল উন্নয়ন করেছেন এমপি মুহিবুর রহমান মানিক। তিনি এখনো এই আসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দিন দিন তাঁর জনসমর্থন বাড়ছে। আওয়ামী লীগ তাঁকে মনোনয়ন দিলে আশা করি, এবারও তিনি রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হবেন।’

দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ইদ্রিস আলী (বীরপ্রতীক) বলেন, ‘মুহিবুর রহমান মানিক এতটাই জনপ্রিয় যে তাঁর সভায় মানুষের ঢল নামে। এখানে তাঁর সমকক্ষ ও জনপ্রিয় বিকল্প আওয়ামী লীগ নেতা তৈরি হয়নি। তিনি মুুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন ও বিকাশের লক্ষ্যে যুদ্ধক্ষেত্র, যুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থানে স্থাপনা তৈরি করে আমাদের শ্রদ্ধা আদায় করেছেন। আমরা আগামীতেও এমন জননেতাকে আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে চাই।’

সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ‘মানুষের ভালোবাসাই আমার শক্তি। আমার বিরুদ্ধে নানা সময় ষড়যন্ত্র করেও তারা সফল হয়নি, বারবার জনতার কাছে পরাজিত হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি ছয়বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার সুবাদে তৃণমূল আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা আমাকে এখনো অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাঁর নেতৃত্বাধীন সংসদের একজন সদস্য হিসেবে এলাকায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করে তাঁর জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বকে তৃণমূলে তুলে ধরেছি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও আশা করি, জননেত্রী আমাকে আবারও মূল্যায়ন করবেন।’

এ ছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে সক্রিয় জেলা আওয়ামী লীগের নবগঠিত কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শামীম আহমদ চৌধুরী। তিনি নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে তাঁর আপন ভাই পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। তাঁদের বলয়ের একাধিক নেতা স্থান পেয়েছেন কমিটিতে। যে কারণে রাজনৈতিকভাবে বর্তমানে সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক কোণঠাসা বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এই আসনে দোয়ারাবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফরিদ আহমদ তারেককেও প্রচার চালাতে দেখা যাচ্ছে।

বিএনপি : সুনামগঞ্জ-২ আসনে বিএনপি তিন ধারায় বিভক্ত। দলের মনোনয়ন লড়াইয়ে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন, ছাতক উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী ও শিল্পপতি সৈয়দ মুনসেফ আলী। এই তিন শক্তিশালী নেতা প্রভাব-প্রতিপত্তিতেও সমানে সমান।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মিলন ও মিজানের নিজস্ব কর্মী-সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে এলাকায়। তাদের নামে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক, সিলেট বিভাগীয় শহর, সুনামগঞ্জ জেলা শহর ও নির্বাচনী এলাকায় ব্যানার সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে।

সৈয়দ মুনসেফ আলীর সমর্থকরাও কম যায় না। তারাও মুনসেফ আলীর পক্ষে মনোনয়ন চেয়ে পোস্টার ব্যানার লাগিয়েছে। মুনসেফ আলী নিজ শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। তিনি নিজেও মনোনয়নের জন্য চেষ্টা-তদবির করছেন বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, কেন্দ্রের একাধিক শীর্ষ নেতা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে এই তিন নেতার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। মনোনয়নের জন্য তাঁরা নিয়মিত তদবির করছেন।

কলিম উদ্দিন মিলন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। তিনি বর্তমানে জেলা বিএনপির সভাপতি।

জেলা বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি গঠনের আগে কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে তলব করেন দলের প্রধান খালেদা জিয়া। দুজনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার নির্দেশনা দিয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন তিনি। এই শর্তে কলিম উদ্দিন আহমদ মিলনকে জেলা বিএনপির সভাপতি পদ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

কলিম উদ্দিন মিলন বাম দল থেকে আসা নেতা। অন্যদিকে মিজানুর রহমান চৌধুরী ছাত্রদল দিয়েই রাজনীতি শুরু করেন। তিনি সিলেট জেলা ছাত্রদলের দুইবারের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কলিম উদ্দিন মিলন সংসদ সদস্য ও মিজান চৌধুরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে নির্বাচনী এলাকায় তাঁদের নিজেদের কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। কর্মীবান্ধব মিজান চৌধুরীর সঙ্গে রয়েছে বিশাল তরুণ গোষ্ঠী, যারা তাঁর সাহস ও সাংগঠনিক দক্ষতাকে পছন্দ করেন।

মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘তৃণমূল বিএনপি নেতাকর্মীরা আমাকে নির্বাচনে প্রস্তুতি নেওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিয়মিত মাঠে থাকায় দলের বাইরেও অনেক সমর্থক আমার রয়েছে। দল আমাকে মূল্যায়ন করলে আমি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই আসনটি খালেদা জিয়াকে উপহার দেব।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার নেত্রীর মুক্তির লক্ষ্যে আমি তৃণমূলে সমর্থন আদায়ের কাজ করছি।’

কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন বলেন, ‘আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির পাশাপাশি তাঁর নির্দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছি। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে আমি মাঠে কাজ করছি।’

অন্যান্য : এই আসনে জাতীয় পার্টি নেতা জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করছেন। মনোনয়নের দাবি জানিয়ে তাঁর সমর্থকরা নির্বাচনী এলাকায় পোস্টার ব্যানার লাগিয়েছেন। দলের আরেক নেতা আ ন ম অহিদও (কনা মিয়া) মনোনয়ন চান। তিনিও নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করছেন। জামায়াতে ইসলামী এই আসনে আব্দুস সালাম আল মাদানীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তাঁর পক্ষে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা প্রচার চালাচ্ছে।

এ বিভাগের অন্যান্য