উন্নয়নের জোয়ার ও সামাজিক অবক্ষয় /আবুল কাসেম ফজলুল হক

বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। এর মধ্যে আগে যাকে ‘পুকুর চুরি’ বলা হতো, স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে তা এখন রূপ নিয়েছে ‘সমুদ্র চুরি’তে। উন্নয়নের জোয়ারের পাশাপাশি সমুদ্র চুরির চিত্রও প্রচারমাধ্যমে কিছু আসে। লোকে উন্নয়নের প্রচারকেও মেনে নিচ্ছে, সমুদ্র চুরিকেও মেনে নিচ্ছে। উৎসাহ কিংবা অভিযোগ কোনোটাই জনসাধারণের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে না। ভাবটা এমন যে, রাষ্ট্রের আয় অনেক বেড়েছে, কাজেই পুকুর চুরি তো সমুদ্র চুরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। জনসাধারণের নৈতিক চেতনা অবনতিশীল। ‘গ-ারের চামড়া’ কথাটা মৌখিকভাবে তো বটেই, লিখিতভাবেও কেউ কেউ সামনে আনতেন। কোনো কোনো প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদের অনুচিত কার্যকলাপ দেখে অনেকে বলতেন, লোকটার লজ্জাশরম নেইÑ গায়ে একেবারে গ-ারের চামড়া। এখন এ ধরনের কথা কেউ আর কারো সম্পর্কে উচ্চারণ করেন না। বাস্তবে দেখা যায়, গ-ারের চামড়াওয়ালারাই সমাজে, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কেবল প্রতিপত্তিশালী নয়, সম্মানিতও। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার দুটি পঙ্ক্তি মনে পড়ছে :

‘যাদের কথায় জগৎ আলো, বোবা আজকে তারা, মুখে তুবড়ি ফোটে তাদের আকাট মূর্খ যারা।’ ‘জাতির বাতিঘর’ বলে যারা নন্দিত হচ্ছেন, জাতিকে কোন গন্তব্যের দিকে তারা নিয়ে চলছেন? যারা জাতির শিক্ষক, জাতির পথপ্রদর্শক, কী তারা করছেন, করবেন? এ সমাজে যার ক্ষতি করার শক্তি যত বেশি, তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তত বেশি। মানুষের কল্যাণ করার শক্তি এ সমাজে কোনো শক্তি বলেই স্বীকৃতি পায় নাÑ স্বাধীন বাংলাদেশের সাতচল্লিশ বছরের সমাজ সম্পর্কে এ কথাটা কি ভুল? সাম্রাজ্যবাদী মহল তাদের সবচেয়ে প্রিয় প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে ১৯৫০-এর দশকের শুরুতেই উন্নয়নের যে সংজ্ঞা নির্দেশনা করেছেন, নানা তর্ক-বিতর্কের ঝড় অতিক্রম করে তা আজও কার্যকর আছে। নানারকম ভালো ভালো প্রতারক উক্তির আড়ালে তাকেই বহাল রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের জোয়ারের কথা খুব প্রচার করেন, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, সমাজের নিচের স্তরের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের দুর্দশার দিকেÑ মানবতার লাঞ্ছনার দিকে তাদের দৃষ্টি প্রায় যায় না! অর্থনীতিবিদ হিসেবে তারা প্রচারমাধ্যমে সব সময় নন্দিত হন! সামাজিক শিথিলতা, অবক্ষয়, ধষরবধৎধঃরড়হ নিয়ে তারা কেউ একটি কথাও বলেন না। মনে হয় এ সমাজকে তারা খুব সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ মনে করেন। বর্তমান অবক্ষয়ক্লিষ্ট পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধ অনুসারী তারা। বলা হয়, বাংলাদেশে কবিতা খুব উন্নতি করেছে এবং কবিতার উন্নতির জোয়ার চলছে। আমি তো বাংলাদেশের প্রবীণ কবিদের কবিতায় জাতির অন্তর্জীবনের চিত্র ফুটে উঠতে দেখি না। আমার কাছে বরং মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দÑ এমনকি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর ধারে কাছে যাওয়ার মতো কোনো কবিতা বর্তমানে সক্রিয় বিখ্যাত কবিদের কবিতাবলির মধ্যে খুঁজে পাই না। মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি কি পর্যাপ্ত আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে খুব সুন্দরভাবে অভিব্যক্তি লাভ করেছে আমাদের কবিতায়? সেøাগানধর্মিতা আছে। আমি হয়তো অনেক কিছু বুঝতে পারিনি। যারা বুঝতে পেরেছেন, তাদের কর্তব্য বুঝিয়ে দেওয়া। যে ভয়াবহ অবক্ষয় সমাজে চলছে, তার চিত্র অনায়াস, সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরার সামর্থ্য আমার নেই। অবক্ষয়ের ধারা সমাজে অনেক দিন ধরেই চলছে। এরই মধ্যে ঘটেছে ইংরেজ শাসকের অবসান, জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদি অসাধারণ সব ঘটনা। এসব ঘটনা অবশ্যই মহান এবং সে উপলব্ধি দেশবাসীর মধ্যে আছে। কিন্তু এই মহান সব ঘটনার মধ্য দিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের ধারা বিলুপ্ত হয়নি এবং উজ্জীবনের কোনো ধারাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এ নিয়ে ব্যাপক ও গভীর চিন্তাভাবনা এবং অবক্ষয় কাটিয়ে উজ্জীবনের ধারায় উত্তীর্ণ হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা দরকার। এখানে অবক্ষয় সম্পর্কে নবচেতনা সৃষ্টির এবং উত্তরণের তাগিদ সৃষ্টির জন্য পরিচিত কিছু কবিতার চরণ সামনে আনব। মোহিতলাল মজুমদার ১৯৪৭ সালের আগে এবং পরে বাঙালি চরিত্রের নবউত্থানের আশায় বাঙালিকে তিরস্কার করেছেন আত্মবিস্মৃত, আত্মভ্রষ্ট, আত্মঘাতী বলে। ওই সময়ের এ বিষয়ের অনেক লেখা তার আছে। তিনি যেসব কথা ঠিক বলেছেন, তা আমি মনে করি না। তবু একটি ঐতিহাসিক অবস্থায় বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক কী উপলব্ধি করেছেন তা অনুসন্ধান করে দেখা আজকের উত্তরণপ্রয়াসীদের কর্তব্য। এটা বাংলাদেশে আমাদের যেমন কর্তব্য, তেমনি ভারতে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদেরও কর্তব্য। কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ্বযুদ্ধ-পীড়িত বৈশ্বিক অবস্থার উপলব্ধি নিয়ে লিখেছিলেন, অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেইÑ প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শিয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। সত্যতার নামে চলমান বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ আছে জীবনানন্দের এই ক’টি কথার মধ্যে। জীবনানন্দ বর্বরতার অবসান ও নতুন সভ্যতার উত্থান কামনা করেছেন। ষাটের দশকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আগে, এই কবিতা আমি, আমরা প্রচার করেছিলাম সংগ্রামরত ছাত্রদের সংগ্রামী স্পৃহাকে ব্যাপকতর, গভীরতর ও তীব্রতর করার জন্য। এ কথা ক’টির আবেদন কি এখন শেষ হয়ে গেছে? বর্বরতার জায়গায় নতুন সভ্যতার উদ্ভব কি ঘটেছে পৃথিবীতে? আইয়ুব শাসনের দুঃসহ দিনগুলোয় কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে কড়িকাঠে চেয়ারে, টেবিলে খাটে দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয় দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি এবং বুলায় তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে আমাদের এক রত্তি উঠোনের কোণে উড়ে আসা চৈত্রের পাতায় পা-ুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায় গ্রীষ্মের দুপুরে ঢকঢক জল-খাওয়া কুজোয় গেলাসে, শীত ঠকঠক রাত্রির নরম লেপে দুঃখ তার বোনে নাম অবিরাম।… বুকের পাঁজর ফুসফুস আর পাকস্থলীতে প্লীহায় যকৃতে আর অন্ত্রের গলিতে দুঃখ তার লেখে নাম। আমার হৃৎপি-ে শুনি দ্রিমিকি দ্রিমিকি দ্রাক দ্রাক দুঃখ শুধু বাজায় নিপুণ তার ঢাক। শামসুর রাহমান দুঃখকে মহিমান্বিত করতে চাননি, তিনি তার উপলব্ধি অনুযায়ী বাস্তবকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দুঃখের মর্মান্তিক চিত্র ফুটিয়ে তুলে তিনি কামনা করছিলেন দুঃখের অবসান। এর পেছনে আধুনিকতাবাদের তত্ত্ব থেকে থাকতে পারে, তবে তার চেয়ে বেশি ছিল চতুষ্পর্শের বাস্তবের পীড়ন। সে জন্যই এসব কথা আবেদনশীল। আইয়ুব শাসনের সেই দুঃসহ দিনগুলোয় কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন, এ কেমন অন্ধকার, বঙ্গদেশ উত্থান রহিত নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায় কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্য কোনো শ্যামলতা নেই। বুঝি না রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন। গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে পুনর্জন্ম নেই আর জন্মের বিরুদ্ধে সবাই। শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি, নিশ্চিত বিশ্বাস এই একটিও উদ্ভিদ হবে না। আপনার বাংলাদেশ এ-রকম নিষ্ফলা ঠাকুর। আল মাহমুদ বাস্তবের তীব্র উপলব্ধি নিয়ে বাস্তবের বিশ্বস্ত ছবি এঁকেছেন। এতে পাঠকদের মনে হতাশা সৃষ্টি হয়নি, প্রতিবাদের স্পৃহা জেগেছে, সবকিছু ভেঙে দিয়ে মহান নতুন কিছু সৃষ্টির আকাক্সক্ষা জেগেছে। আল মাহমুদের এ কবিতাও প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং তরুণদের মুখে মুখে উঠেছিল। এর পর দেখা দিয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মার্চের সর্বাত্মক জাতীয় অভ্যুত্থান, নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তানকালে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর্যায়ে আমাদের জাতি যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই সৃষ্টিশীলতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আর এগোতে পারেনি। স্বার্থের সংঘাত ও অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পড়ে জাতি তার সৃষ্টিশক্তি ও সৃষ্টি সম্ভাবনার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটাতে পারেনি। পশ্চিমের অন্ধ অনুসারী হয়ে জাতি স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও তার পেছনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দ্বারা। সুশীল সমাজ (ঈরারষ ংড়পরবঃু ড়ৎমধহরমধঃরড়হং) কী করে চলছে? তাদের প্রদর্শিত পথ ধরে বাংলাদেশ কি তার সৃষ্টিশক্তিকে পুনর্গঠিত করে কার্যকর করতে পারবে? কথিত সুশীল সমাজ আদৌ সৃষ্টিশীলতার অনুকূল? গণতন্ত্রের অনুকূল। তাদের ভালো ভালো কথার ফল তো বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের জনগণের জন্য খারাপ হচ্ছে। কিছু লোকে বলে থাকেন, এখন দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ক্ষমতায় আছে, দেশ খুব ভালো চলছে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কায়েম হয়ে চলছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন না হলে, বেশি সময় লাগবে না, সোনার বাংলা পূর্ণতা পাবে। ভালো কথা। কিন্তু তারা উন্নয়নের জোয়ার ছাড়া আর কিছু দেখেন না। তারা অবক্ষয়, অপব্যয়, অপচয়, সামাজিক শিথিলতা, ধষরবহহধঃরড়হ ইত্যাদির দিকে দৃষ্টি দেন না। আসলে সেদিকটাতেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। যেসব সমস্যা সহজে সমাধান করা যায়, জনস্বার্থে সেগুলো সমাধান করে ফেলা দরকার। ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি’ বলে আমরা যদি খুব বেশি দম্ভ প্রদর্শন করি, তা হলে জনগণ আমাদের প্রতি বিরূপ হয়ে যেতে পারে এবং তার সুযোগ ‘মুক্তিযুদ্ধের ‘বিপক্ষশক্তি’ নিয়ে নিতে পারে। কেবল ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি’ হয়ে থাকলেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন, সমাজ গঠন ও জনজীবনের সমাধানযোগ্য সমস্যাবলি সমাধানের দায়িত্বও পালন করতে হবে। কেবল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা উপভোগের মধ্যে থেকে আমরা ভুল করছি। যারা ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ তাদের বুঝতে হবে যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি’ থেকে তারা বাংলাদেশে নাগরিক থাকার যোগ্যতা হারাচ্ছেন। জনগণের ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে স্বীকার করে নিয়ে তারা বাংলাদেশে নিজেদের অস্তিত্বকে সমৃদ্ধ ও শক্তিমান করতে পারবে। আমরা ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে বিরোধের অবসান চাই।

 

 আবুল কাসেম ফজলুল হক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিভাগের অন্যান্য