সিলেটে যেভাবে ধানের শীষে দলীয় মনোনয়ন পেলেন আরিফ

 

সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আরিফুল হক চৌধুরীর হাতেই ধানের শীষ তুলে দিয়েছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বুধবার বিকেলে আরিফুল হক চৌধুরীর হাতে মনোনয়নপত্র তুলে দেন। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। মনোনয়নপত্র তুলে দেয়ার আগে দলের চেয়ারপার্সনের গুলশানের কার্যালয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীরাসহ সিলেট বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করেন মহাসচিব। বৈঠকে দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়। মহানগর সভাপতি নাসিম হোসাইনসহ ৩ মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও মর্মাহত হয়েছেন মহানগর সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি’র একাধিক নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী ঘোষণার লক্ষ্যে সিলেট বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১১ টার পরে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে সেলফোনে কথা বলেন। কথা বলেন, জেলা ও মহানগরের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথেও। মহাসচিব জানান, বুধবার দুপুর ১২টার আগে দলের চেয়ারপার্সনের গুলশানের কার্যালয়ে সকলকে উপস্থিত থাকতে হবে। মহাসচিবের তলব পেয়ে গতকাল বুধবার সকালের একটি ফ্লাইটে নেতৃবৃন্দ সিলেট থেকে ঢাকায় পৌঁছে। ঢাকার উত্তরার একটি হোটেলে সকালের নাস্তা এক সাথেই করেন তারা। পরে যান গুলশান অফিসে। সেখানে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত মহাসচিব বৈঠক করেন। বিএনপি’র নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুল মঈন খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও ড. এনামুল হক চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপি’র সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, বর্তমান মেয়র ও দলের মেয়র পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী আরিফুল হক চৌধুরী, মহানগর সভাপতি নাসিম হোসেইন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী, সহ-সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, জেলার সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজমল বখত চৌধুরী সাদেক, জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমদ সিদ্দিকী অংশ নেন। প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকের শুরুতেই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষপটে দলের ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য দেন। এরপর মেয়র প্রার্থীরাসহ নেতৃবৃন্দ দলীয় ব্যাপারে নানা কথা বলেন। কেউ কেউ আরিফুল হক চৌধুরীর নানান সমালোচনাও করেন। পরে মহাসচিব বলেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরীকেই মেয়র পদে প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। সিলেট তার গ্রহণযোগ্যতা-জনপ্রিয়তা রয়েছে। সিলেটের উন্নয়নে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বর্তমান মেয়রও। এজন্যে বিএনপি’র এই সিদ্ধান্তকে সকলে মেনে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে হবে। সিলেটে ধানের শীষ বিজয়ী হলে সরকার বিরোধী আন্দোলনেও গতি আসবে। সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেন মহাসচিব। পরে আরিফুল হক চৌধুরীর হাতে দলের মনোনয়নপত্র তুলে দেয়া হয়। বৈঠক শেষে আরিফুল হক চৌধুরীসহ বৈঠকে অংশ নিতে যাওয়া নেতৃবৃন্দ সড়কপথে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। মেয়র পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী নাসিম হোসেইন ও রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বৈঠকে এ সকল আলোচনার বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, মেয়র পদে আরিফুল হক চৌধুরীর নাম ঘোষণার সংবাদটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন। অবশ্য কেউ কেউ এতে মর্মাহত হয়েছেন বলেও সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি’র মনোনয়নের লক্ষ্যে গত ২১ জুন ৬ প্রার্থী গুলশান কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় দলের মনোনয়ন বোর্ড ৬ প্রার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর বলা হয় প্রার্থীর ব্যাপারে দলের সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে। সমনোনয়ন প্রত্যাশী ৬ জন হলেন, বর্তমান মেয়র ও দলের কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী, মহানগর সভাপতি নাসিম হোসেইন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী, সহ-সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সালাহ উদ্দিন রিমন। মনোনয়ন বোর্ডের সাক্ষাৎকার গ্রহণের আগ পর্যন্ত ধারণা করা হয়েছিল আবারো আরিফকেই প্রার্থী দেবে বিএনপি। কিন্তু ঐদিন কোনো ঘোষণা না দেয়ায় জল্পনা-কল্পনার ডালপালা মেলতে শুরু করে। কে হচ্ছেন দলের প্রার্থী আরিফ না সেলিম না অন্য কেউ। এমন আলোচনা ছিল দলটির ভেতরে ও বাইরে। কিন্তু বিএনপি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র সিলেটের ডাককে নিশ্চিত করেছিল যে, আবারো আরিফকেই মেয়র পদে প্রার্থী দেবে বিএনপি। জোটের সাথে আলোচনার পর তাকে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী করা হবে। শেষ পর্যন্ত সকল জল্পনা-কল্পনার অবসানের পর আরিফুল হক চৌধুরীকেই প্রার্থী দিলো জাতীয়তাবাদী দল। তবে এখনো ২০ দলীয় জোটগতভাবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অন্যতম নাসিম হোসেইন বলেন, দল যেহেতু প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে তাই দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। মান-অভিমান ভুলে কঠিন এই সময়ে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জোটের সাথে আমরা বসবো। বসে আলোচনা করে একক প্রার্থীর ঘোষণা আসবে। আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী বলেন, দলের সিদ্ধান্ত মেনেই আমরা কাজ করে যাবো। দলীয় সিদ্ধান্ততো আমরা মেনেই নিয়েছি। কিন্তু জয়-পরাজয় নির্ভর করবে ভোটারদের উপর। এজন্যে ভোটারদের নিকট সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে যেতে হবে। মনোনয়ন প্রত্যাশী রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। দলের এই দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি’র বিকল্প নেই। ধানের শীষের বিজয়ের লক্ষ্যে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অন্যতম বদরুজ্জামান সেলিম সিলেটের ডাককে বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তে আমি খুশি নয়। এই সিদ্ধান্তে আমি মর্মাহত। সিলেটের নেতাকর্মীরা নতুন নেতৃত্বের প্রত্যাশা করেছিল। অন্য প্রার্থীরাও তাই বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা না বুঝেই মহাসচিব ডেকে নিয়ে ঘোষণা দিয়ে দিলেন।’ নির্বাচন ঐক্যবদ্ধভাবে করতে মহাসচিবতো নির্দেশ দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপাতত এ বিষয়ে কিছু বলছি না। সময়ই বলে দেবে কখন কি করতে হবে।’ দলের মনোনয়ন পেয়ে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমাকে পুনরায় মনোনয়ন দেয়ায় দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নিকট কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক। দলের সিদ্ধান্তের উপর তৃণমূলের নেতাকর্মীরা একাত্ম হয়ে কাজ করবেন বলে আশা করেন। নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ের মাধ্যমে চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলার প্রতিবাদ ও আওয়ামীলীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নগরবাসী প্রতিবাদ করবেন। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১৫ জুন শনিবার অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৩য় নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী আওয়ামীলীগ প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে ৩৫ হাজার ১৫৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচনে টেলিভিশন প্রতীকে আরিফুল হক চৌধুরী পান ১ লক্ষ ৭ হাজার ৩৩০ ভোট এবং আনারস প্রতীকে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছিলেন ৭২ হাজার ১৭৩ ভোট।

এ বিভাগের অন্যান্য