নতুন সূর্যের প্রত্যাশা:পূর্ণতা আঞ্জুম

আমরা হয়তো বরণ করি বটতলায়। বন্ধুর বাড়ি। কিংবা হিমশীতল কোনো রেস্টুরেন্টে। মৃদু-স্নিগ্ধ সুরে ‘এসো হে বৈশাখ… এসো… এসো…’। কিন্তু আমাদের মায়েরা? ছেলেমেয়েসহ সংসারের সবার জন্য নতুন পোশাক তৈরি করে সেদিন কী খাবার হবে সেই ব্যবস্থায় নেমে যান। সন্তানের বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের অতিথি কিংবা স্বামীর কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীরা। কে বাদ থাকেন? আপ্যায়নে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন মায়েরা। সংসারের কর্ত্রী। কিন্তু বর্ষবরণে তারও যে কিছু একটা করার আছে- এটা ক’জনে ভাবেন?

সার্বজনীন উৎসব আমাদের। উৎসবের দিন যতই এগিয়ে আসে, মন উথাল-পাথাল। নতুন বছরের ছোঁয়া এসে লাগে গায়ে। পুরনোকে বিদায় জানিয়ে মানুষ একেবারে নতুন করে বরণ করে নেয় বছরটিকে। আমাদের জানা আছে, সম্রাট আকবরের সময় থেকেই মূলত বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়। সারা বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার আর ভূ-স্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতেন। পরদিন নতুন বর্ষে ওই ভূ-স্বামীরা সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতেন। এরই সূত্র ধরে শুরু হয় মেলা। বাড়িতে বাড়িতে একটু-আধটু রান্নাবান্না। শুভ একটি দিন দিয়ে বছরের সূচনা।

হালখাতা শব্দটি তো হিসাব-নিকাশের সঙ্গেই যুক্ত। গ্রাম-নগরের ব্যবসায়ীরা পুরনো খাতা তুলে রেখে নববর্ষের দিন খুলতেন হিসাবের নতুন খাতা। নতুন-পুরনো খদ্দেরদের জন্য থাকত অবারিত মিষ্টিমুখ। নতুনভাবে শুরু হতো ব্যবসায়িক যোগসূত্র। এই অনুষ্ঠানটি আজও আছে।

বৈশাখী মেলাগুলো টিকে আছে এখনও। সার্বজনীন এই লোকজ মেলা মন কেড়ে নেয় সবার। কত ধরনের পণ্য যে আসে এই মেলায়! আর থাকে চিড়া-মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা-খইয়ের অমৃত সম্ভার। কত রকম পিঠা! বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসেন গায়ক, নর্তক। চলে লোকগান-বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি। লাইলি-মজনু, ইউসুফ- জুলেখার আখ্যানও চলে কোথাও কোথাও। পুতুল নাচ, নাটক, সার্কাস, নাগরদোলাই বা বাদ যাবে কন? বর্ষবরণের দিনে পান্তা ভাত আর ইলিশ ভাজা খাওয়ার একটা রেওয়াজ শুরু হয়েছে। কাঁচামরিচ বা শুকনো মরিচ, আলুভর্তা, বেগুন ভাজাও থাকছে সঙ্গে। খাওয়ার এই রেওয়াজটা অনেকেই পালন করছেন। তবে বছরের এ সময়টায় ইলিশ মাছের থাকে খুব দাম। ফলে ইচ্ছা হলেই সবাই তা খেতে পারে, এমন নয়।

নববর্ষের মূল আনন্দই হলো বর্ষকে বরণ করে নেওয়া। নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি, লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, গলায়-খোঁপায় মালা পরা মানুষেরা এ দিনটি থেকে পরবর্তী দিনগুলোয় আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়। এই দিনে অনেকেই অনেককে উপহার দেন। সেরা উপহার হয়ে উঠতে পারে বই। বন্ধুরা এক হয়ে গাইতে পারে কিংবা শুনতে পারে গান। লোকজ গানের মধ্যে বিভোর হয়ে যেতে পারে। মেলা থেকে কেনা যেতে পারে লোকজ পণ্য।

পরিবারের সবার সঙ্গে নিজের জীবনের হালখাতায় ভালো কিছু যোগ হোক- এমনটা আশা করেন নারী। কিন্তু সবার মঙ্গলকামী নারীর হালখাতায় বছর শেষে জমা হয় বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন আর অত্যাচারের ভয়াবহ চিত্র। তারপরও নারী স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রভাতের। নতুন প্রভাতের আলোয় কেটে যাবে বিগত দিনের সব অমানিশা। খাবারের আয়োজনে কিছুটা কমতি হলে মন খচখচ করতে থাকে। মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ূ, হাত সেমাই হলে আরও ভালো হতো। কাঁচা আমের ভর্তায় কাসুন্দি দেওয়া হয়েছে। তাতে কাঁঠালের মোচা দিতে পারলে বেশ হতো। পান্তা ইলিশ, কয়েক পদের ভর্তা, ফিরনি, দই আছে। তারপরও বাঙালি খাবার যা অনেকদিন খাওয়া হয়নি, তেমন কিছু টেবিলে রাখতে পারলে আয়োজনটা পূর্ণ হতো। এমন অতৃপ্তি যেন থেকেই যায় অধিকাংশ নারীর মধ্যে নববর্ষ উৎসব পালনের আয়োজনে। বাঙালি আপ্যায়নপ্রিয় জাতি। উৎসব অনুষ্ঠানে তা আরও বেশি প্রাধান্য পায়। আর নারীর মমতাময়ী মন, আন্তরিকতা, সুনিপুণ দক্ষতা নানা আয়োজনে মিশে উৎসব প্রাণ পায় নতুন মাত্রায়। এ ধারায় বাঙালির সার্বজনীন নববর্ষ উৎসবকে প্রাণ দিতে কোনো রকম ত্রুটি রাখতে রাজি নন তারা। যার যার অবস্থান থেকে নারী সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেন নববর্ষ আয়োজনে কতটা নতুনত্ব আনা যায়। তা নিয়ে চলে এক রকম প্রতিযোগিতাও। নতুন পোশাকটি কেমন হবে; ব্লক, বাটিক, ফুল, লতাপাতা, হাতি-ঘোড়ার মোটিফ, না কবিতার ক্যানভাস হবে পোশাক! চুড়ি, মালা, দুল, আলপনা আঁকা- সব মিলিয়ে মহাআয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উৎসবকে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে চলেছেন নারী। চেতন-অবচেতনভাবে উৎসব-ঐতিহ্যকে এভাবে যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে ধারণ করে রেখেছেন নারী দীর্ঘকাল ধরে। আমাদের সমাজে আচার-অনুষ্ঠানের কমতি ছিল না কোনোকালেই। অন্তঃপুরবাসিনী মেয়েরাই নিভৃতে লালন করতেন সেসব। ধর্মীয় কারণ তেমন বিভেদ সৃষ্টি করেনি এসব গ্রাম্য লোকাচারে। রান্নার পর খাওয়া, খাওয়ার পর রান্না, নারীর জীবনে কৃষিভিত্তিক নানা আচার-অনুষ্ঠান এবং লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান পালন ছিল একটু মুক্তি। প্রাণের স্পন্দনে মেতে ওঠার একটু অবকাশ। যুগ যুগ ধরে সে চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন এ দেশের নারীরা।

আজও চলছে একই ধারায়। উৎসব নিয়ে এক ধরনের স্বপ্ন বা প্রত্যাশা ঘিরে রাখে নারীর মন। নতুন বছরে নতুন প্রত্যাশা সবার। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কৃষক পরিবারের গৃহিণীরা যে প্রস্তুতি নিতেন আমানি তৈরির; এখনও অনেক গৃহস্থ পরিবারে এমন আয়োজন হয়। এর মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা থাকে। আমানি তৈরিতে; হাঁড়িতে অনেকটা পানি দিয়ে তার মধ্যে চাল ভেজাতেন। সঙ্গে থাকত পাতাসহ আমের ডাল। নতুন বছরে প্রথম প্রহরে এই ভেজানো চাল খেতে দিতেন সবাইকে। আমের পাতা দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিতেন সবার গায়ে। উদ্দেশ্য ছিল সংসারে সবার সুস্বাস্থ্য কামনা। প্রথম ভোরে পান্তা খেয়ে মাঠে কাজ করতে যাওয়ার পেছনে ছিল সারা বছর অন্নপ্রাপ্তির প্রত্যাশা।

এখন নববর্ষে শহুরে জীবনে বছরের প্রথম দিনটিতে ভালো খাওয়া বা নতুন পোশাক পরার পেছনেও থাকে একই প্রত্যাশা। গত বছরের জরাজীর্ণ দূর হয়ে নতুন বছরটি স্বামী, সন্তান, পরিবারের সবার মঙ্গল এবং শান্তি বয়ে আনুক- এই প্রত্যাশায় নববর্ষের হালখাতা খোলেন নারীরা। পরিবারের সবার সঙ্গে নিজের জীবনের হালখাতায় ভালো কিছু যোগ হোক- এমনটাও আশা করেন। বছর ঘুরে নতুন প্রভাতে বরণ করি সব।

কিন্তু হালখাতায় নিজেকে লুকানোর অবকাশ তো কম থাকে না। সারা বছরের দোকানে পাওয়া বকেয়াগুলো কোনো এক সময় না হয় ঘরের গোলা থেকে ধানের বিনিময়ে কিংবা গাছের ফল-সবজির বিনিময়ে মেটানো যেত হিসাবের এপার-ওপার। এখন কি সেই দিন আছে? আছে গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ? অভাব তাই নিত্য ছাড়ে না পিছু। তারপরও জীবনের খেরোখাতার হিসাব শেষ হোক। নতুন সূর্য উঠুক।

এ বিভাগের অন্যান্য