হাওরে কৃষকের মুখে ধানের হাসি

সোনারঙা পাকা ধান এখন দ্যুতি ছড়াচ্ছে বিস্তীর্ণ হাওরে। ধানের ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এ সৌরভ স্পর্শ করছে কৃষকের মনে। কিন্তু গত বছর চৈত্রের শেষ সময়ের দিনগুলো এমন ছিল না। সর্বনাশা বর্ষণ হাওরের বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব পাকা ও আধাপাকা ধান। এর সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। ধান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন হাওরের হাজার হাজার কৃষক। এবারও সেই শঙ্কা, সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। কারণ, হাওরের অনেক স্থানে বাঁধ নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতিরও খবর পাওয়া গেছে। তারপরও হাওরের কৃষকরা নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনেছেন। শুরু করেছেন ধান কাটা। মুখে ফুটেছে হাসি।

সিলেট : এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সিলেট অঞ্চলের ১১ লাখ কৃষকের ঘরে উঠবে প্রায় ২০ লাখ টন চাল। সবকিছু ঠিক থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল উৎপন্ন হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা। তবে কিছু এলাকায় ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় কৃষকরা হতাশার মধ্যে রয়েছেন।

সিলেট বিভাগের চার জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি কৃষকরা। পাকতে শুরু হওয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ; সুনামগঞ্জের ছাতক, জগন্নাথপুর; মৌলভীবাজারের বড়লেখা, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, নবীগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ধানকাটা শুরু হয়েছে।

সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আলতাবুর রহমান  বলেন, এবারের ফসলের অবস্থা ভালো। কয়েকদিনের মধ্যে পুরোদমে ধানকাটা শুরু হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হবে। তিনি জানান, তাহিরপুরসহ কিছু এলাকায় পানি থাকায় ধান পাকতে আরও ১০-১৫ দিন সময় লাগবে। ধানে ব্লাস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে তা হয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জ : ”২৮ ধান কিছু কাটলাম, যদি সপ্তাহ্‌-দশদিন আল্লায় দিন ঠিক রাখইন, ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত না হয়, তাইলে ‘ধুম্বইল’ (আনন্দ-উল্লাস করে) দিয়া এইবার ধান কাটমু। কাছির ভারি শুরু হলে ধান আরও তাড়াতাড়ি পাকবো।” শুক্রবার দুপুরে দেখার হাওরে ধান কাটতে কাটতে কথাগুলো বলছিলেন হাওরপাড়ের জলালপুর গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন।

জমির পাকা ধানে কাচি টান দিতে দিতে হাওরপাড়ের সচিন্দ্র কুমার দাস বলেন, ‘গতবার তো ধানের গোটা দেখছি না, এইবার ধানও হাত লাগাইছি। গতকালকে কিছু ২৮ ধান কাটছি, আজকেও কাটলাম, এর মধ্যে এক মণ ধান এক হাজার টাকায় বিক্রিও করেছি।’ তিনি জানান, দেখার হাওরে এইবার ২৮ ধান প্রতি একরে ৩০ থেকে ৩২ মণ হবে। ২৯ ধান হবে প্রতি একরে ৪৫ থেকে ৪৭ মণ।

এই হাওরে শুক্রবারই প্রথম ধান কাটতে এসেছেন হাওরপাড়ের সাধকপুরের কৃষি শ্রমিক মনির মিয়া। ৬ ভাগের এক ভাগ চুক্তিতে ধান কাটছেন তিনি। মনির মিয়া বললেন, ‘একদিনে এক মণের মতো পাইমু। আল্লায় যদি বৈশাখী দেইন, এক মাসে ২৫-৩০ হাজার রোজগার করমু।’

হাওরপাড়ের জলালপুরের কৃষক ফজলু মিয়া জানালেন, এবার ধান ভালো হয়েছে, খুব বেশি বৃষ্টি না হলে ১৫ দিনের মধ্যেই বেশিরভাগ ধান কেটে আনা যাবে।

জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুরের হালির হাওরের উঁচু অংশে, জগন্নাথপুরের মইয়ার হাওর, নলুয়ার হাওর ও পিংলার হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঢুকলাখাই, পাগলার দক্ষিণের হাওর, কাচিভাঙা হাওর, রাঙামাটি ও নাগডরা হাওরে ধান কাটার উৎসব শুরু হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক স্বপন কুমার সাহা বললেন, সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় এবার ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ লাখ ৯৩ হাজার টন। এবার ফলন যেভাবে হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য