ছিনতাইকারীর কাছে অসহায় সিলেট নগরবাসী
সিলেটের সময় ডট কম:
এক বা একাধিক শিকার হাত ফসকে গেলেও জনবহুল নগরীতে অসহায় শিকারের কোনো অভাব নেই। রাস্তাঘাটে নিরপরাধকে অপরাধী বানানোর কৌশল। গায়ে ধাক্কা, পায়ে পা মাড়ানো, হোঁচট খাওয়ার ভান করে কাছে আসছে। অহেতুক ঝগড়া বাধাচ্ছে। নানা ছুঁতোয় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। সেক্ষেত্রে কয়েকজনের ছিনতাইকারী দল ভাগ হয়ে আগে পরে অনুসরণ করছে পথচারীদের। তাদের মধ্যে নানা বয়সী ছিনতাইরীদের দায়িত্বও পৃথক। থাকছে দাড়ি-গোঁফসহ পাজামা-
ঘটনা-২: মদনমোহন কলেজের শিক্ষিকা। কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। রিক্সায় করে কলেজে যাবার পথে আলীয়া মাদ্রাসা মাঠের পশ্চিমের মাদার কেয়ার ক্লিনিকের সামনে পৌঁছামাত্রই ৩ যুবক শিক্ষিকার গতিরোধ করে। এরপরের ঘটনা বীভৎস। ধারালো ছোরা বের করে যুবকরা শিক্ষিকার সাথে যা আছে সবই দিয়ে দিতে বলে। ধারালো ছোরা দেখে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষিকার শরীরে কম্পন শুরু হয়। জীবন রক্ষায় ভয়ে শেষ পর্যন্ত মোবাইল সেটসহ নগদ অর্থ তুলে দেন মানুষরূপী ছিনতাইকারীদের হাতে। ঘটনার পরক্ষণেই মোটরসাইকেলে দ্রুত চলে যায় তারা। শিক্ষিকা কেবলই অসহায় অবস্থায় দেখলেন, তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য। এই ঘটনায় এখনো ভয়ে আতঙ্কিত এই শিক্ষিকা।
ঘটনা-৩: উত্তরাঞ্চলের জেলা দিনাজপুর থেকে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন পুণ্যভূমি সিলেটে। কদমতলী বাসটার্মিনাল থেকে রিক্সাযোগে তারা হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। জিন্দাবাজারে আসার পরই পরিচ্ছন্নতা কর্মীর বেশে থাকা ছিনতাইকারী ঝাঁপিয়ে পড়ে দিনাজপুর থেকে আসা লোকটির উপর। ছিনতাইকারী ছুরিকাঘাত করে লোকটির মানিব্যাগটি নিয়ে নেয়। মানিব্যাগে ১৫ হাজার টাকা ছিল। পরের ঘটনাটি বড়ই মর্মান্তিক। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা লোকটি মাজারে পৌঁছার আগেই প্রিয়তমা স্ত্রীর সামনেই প্রাণ হারালেন। এই ঘটনাটি নগরবাসীর মনে নাড়া দেয়। ভুক্তভোগী লোকজন ও স্থানীয় সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা জানা গেছে। সিলেট নগরীতে এভাবে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকায় লোকজন ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। হায়েনাদের ধারালো ছোরায় কেবল সাথে থাকা মালামালই নয় জীবনও দিতে হচ্ছে। এমনই ঘটনায় গত রোববার দিবাগত রাতে ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহিদ আল সালাম। মানিব্যাগে থাকা মাত্র আড়াইশ’ টাকার জন্য প্রাণ হারান সম্ভাবনাময় এই যুবক। ভুক্তভোগীদের মতে, সিলেট নগরীতে ছিনতাইকারীরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভুক্তিভোগী লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট নগরীর প্রতিটি এলাকায় কোনো না কোন দিন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পাড়া মহল্লা থেকে শুরু করে প্রধান সড়কগুলোতেও ছিনতাইকারীরা বহাল তবিয়তেই বিচরণ করে। বিশেষ করে সকালে কর্মজীবী নারী, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন।
রাতের বেলায় এক মোটরসাইকেলে ৩ জন হরহামেশা ঘুরলেও এনিয়ে তাদেরকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয় না। চৌহাট্টায় ছিনতাইকারীদের পাকড়াও এর বদলে রিক্সায় যাতায়াতকারী সাধারণ লোকদের টহল পুলিশ হয়রানী করে বলেও অভিযোগ আছে।
উপশহরের শাহজালাল সেতু, কীনব্রীজের উভয় দিক, চৌহাট্টা, মিরেরময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন লোকজন। ছিনতাইকারীর তালিকায় রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক ছাড়াও পুলিশ সদস্য কিংবা পুলিশ কর্মকর্তার পুত্রের নাম উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মাহিদ আল সালামকে ছিনতাই ও হত্যার ঘটনায় প্রথম দিন গ্রেফতার হওয়া দুজনের একজন তায়িফ মো: রিপন। রিপন নগরীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার পিতা কুমিল্লা জেলা পুলিশে কর্মরত উপ- পরিদর্শক ইউনুস আলী।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের শিকার অনেকেই নানা ঝামেলার ভয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হতে চান না। সংবাদপত্রে ঘটনার বিবরণ দিলেও বেশিরভাগ ভুক্তভোগী নিজের পরিচয়টুকু প্রকাশ করতে রাজি হন না। ছিনতাইকারীদের হাতে সর্বস্ব খোয়ানোর পর প্রাণ হারানোর ঘটনায় নগরবাসীর মাঝে ভয়- আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ভুক্তভোগী লোকজন ছিনতাইকারীদের গডফাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযানের দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ছিনতাইয়ের বিষয়টি রাজনৈতিক কোন ইস্যু নয় এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেখার বিষয়। নির্বাচনের বছরে পুণ্যভূমি সিলেটে ছিনতাইকারী বেপরোয়া হওয়াটার ব্যাপারে সন্দেহ আছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই শান্তির নগরীতে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জিরো টলারেন্স হলেই নগরবাসী শান্তিতে থাকতেন। তিনি এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার দাবি জানান।
সিলেটের অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট শামসুল ইসলাম বলেন, গডফাদারদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন না নেয়ায় ছিনতাইকারীরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানও নেই। সাংবাদিক ফতেহ ওসমানীসহ মাহিদ পর্যন্ত অনেকেই ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। ছিনতাই প্রতিরোধে সাড়াঁশি অভিযানের তাগিদ দেন তিনি।
মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব এ বিষয়ে বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে আছে পুলিশ। মাহিদের ঘাতক ছিনতাইকারীদের ৪ জনের মধ্যে ৩ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছুরিকাঘাতকারী স্বীকারোক্তি দিয়ে সব বলেছে। ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।