সর্বোচ্চ ফলনের পথে দেশ
কৃষিই হলো দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। সেই কৃষিখাত এগিয়ে চলেছে। নানা প্রতিবন্ধকতা এবং অসুবিধার মধ্যেও গ্রামীণ কৃষিতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন গতিশীলতা। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম রেকর্ড পরিমাণ জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। শুধু আবাদ নয়, মাঠই বলে দিচ্ছে সর্বোচ্চ ফলনে রেকর্ড সৃষ্টির পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে চলতি বোরো আবাদে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমি বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অনেকটা কল্পনাতীত। দেশের সবখানেই কমবেশী বোরো আবাদ লক্ষমাত্রা অতিক্রম করেছে।
বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত গত মৌসুমের বোরো ও রোপা আমনের উৎপাদন ঘাটতি পুষিয়ে যাবে বোরোতে। ধান ও চালের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে পারতপক্ষে এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখেননি দেশের কোন কৃষক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে থেকে কৃষকদের আবাদ ও উৎপাদনের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিচ্ছেন। সারাদেশের মাঠে মাঠে ধান আর ধান। দিগন্ত জুড়ে বাতাসে সবুজের ঢেউ খেলছে। দ্রæত বেড়ে উঠছে বোরো ধান। প্রতিদিনই পাল্টে যাচ্ছে সবুজ মাঠে ধানী জমির চেহারা। ভিন্ন আমেজ কৃষকদের হৃদয়ে সঞ্চারিত হচ্ছে। একদন্ড ফুরসত নেই তাদের। আশায় দিন গুনছেন তারা কবে কষ্টের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এই তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মবীর কৃষকদের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মহসীন আলী গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সারাদেশের বোরো আবাদ পরিস্থিতি খুবই ভালো। আল্লাহর রহমতে এবার সর্বোচ্চ রেকর্ড ফলন হবে। যা ইতিপুর্বে কখনোই হয়নি। কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে দেখেছি মাঠের চারিদিকে ধান আর ধান। কোথাও বুটিং, কোথাও ফ্লাওয়ারিং ও কোথাও বাড়ন্ত স্টেজে আছে বোরো ধান। তিনি বলেন, মধ্য এপ্রিলে হবিগঞ্জ থেকে ধান কাটা শুরু হবে ইনশাআল্লাহ। বলা যায়, বাম্পার ফলনের পথে বোরো। তার কথা, সামগ্রিক কৃষির দিকে সরকার বিশেষভাবে নজর দিয়েছে। তার প্রমাণ ৬৪ জেলায় বোরোর পর আউশে প্রণোদনা কার্যক্রম ঘোষণা করা হয়েছে। আউশে ব্রি-৪৮ জাতের ধান আবাদ করা হবে, যাতে ফলন বোরোর মতোই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানায়, বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে গত বোরো ও রোপা আমনসহ ফসলের কমবেশী ক্ষতি হয় ঠিকই কিন্তু তা ছিল আশীর্বাদ। প্রকারান্তরে সামগ্রিক কৃষির লাভ হয়েছে। বন্যায় পলি পড়ে মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করেছে। চলতি মৌসুমে ধান গাছের জন্য হয়েছে যথেষ্ট সহায়ক। সব মিলিয়ে কৃষি সম্প্রসারণের রেকর্ড ঘেটে দেখা যায়, আবাদ ও উৎপাদনের শীর্ষে হচ্ছে বোরো। এবারই প্রথম দেশে অতিরিক্ত জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সারাদেশে সবখানে বোরো আবাদের রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
সুত্র জানায়, সারাদেশে চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদ এরিয়া বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ লাখ ১০হাজার হেক্টরে। চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা অতিমাত্রায় ঝুকে পড়েছেন বোরো ধান চাষের দিকে। গম, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল আবাদ এবার খুবই কম হয়েছে। সেই সব জমিতে ধান চাষ করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে গত বোরো ও রোপা আমন মৌসুমে উৎপাদন ঘাটতি পুরণে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী জমিতে আবাদ হওয়ায় আশা করা হচ্ছে চাল উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হবে এবার। কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কৃষি কর্মকর্তাদের কাগজ কলমের হিসাব জানি না। ধানের দাম ভালো পাওয়ায় এবং চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকরা বোরো আবাদের দিকে ঝুকে পড়ে এবং কোমর ঁেবধে মাঠে নামে। তার ফলও পাবো ইনশাআল্লাহ। বিভিন্ন এলাকার মাঠের খবর নিয়ে জানা গেছে, স্বাচ্ছন্দ্য অনায়াস উদ্দীপনা ও উদ্যম নিয়ে বোরো চাষীরা মাঠে কাজ করছেন। ধান পরিচর্যা ও সেচ দেয়াসহ প্রায় সারাক্ষণই রয়েছেন ব্যতিব্যস্ততা। ধানের মাঠ দেখে শুধু কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তা নয়, সবাই খুশী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিস উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল হান্নান সারাদেশের মাঠের সার্বিক অবস্থা উল্লেখ করে দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আবহাওয়া ধান গাছের অনুকুলে রয়েছে। কৃষকদের সমস্যা সমাধানেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এবার বোরো আবাদ আগেভাগেই করা হয়েছে। যার কারণে কৃষকরা নিরাপদেই ফসল ঘরে তুলতে পারবে। দেরীতে আবাদ করলে প্রাকৃদিক দুর্যোগের ঝুকি থাকে। সংশিষ্ট সুত্র জানায়, বোরো আবাদে সেচের জন্য সারা দেশে প্রায় ১৪ লাখ ডিজেলচালিত ও প্রায় আড়াই লাখ বিদ্যুৎচালিত গভীর ও অগভীর নলকুপ ব্যবহার হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কোথাও সেচ সংকট হয়নি। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এবার বোরো চাষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কারণে বোরো বীজের সংকট হয়নি। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় বীজতলার অবস্থাও ছিল ভালো। বিএডিসি’র হাইব্রিড বীজের ব্যাপক চাহিদা ছিল কৃষকদের কাছে। বেশী ফলনের আশায় কৃষকরা বেশী বেশী হাইব্রিড জাতের ধান চাষাবাদের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। মেহেরপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচাল কৃষিবিদ ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, আমি এখন মাঠে রয়েছি। যেদিকে তাকাই শুধু ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। সাধারণ কৃষকদের চোখের কোণে এখন খুশীর ঝিলিক। জেলায় ২১ হাজার হেক্টর জমি ছিল টার্গেট সেখানে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। আবাদ পরিস্থিতি খুবই ভালো। ধানের গাছ এখন বাড়ন্ত পর্যায়ে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার কৃষক আব্দুর রহিম, যশোরের শার্শার ডিহি ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলম বাবুল আক্তার ও জসিম উদ্দীন, ঝিনাইদহের চরমুরারীদহ গ্রামের ছমির উদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন কৃষক অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জানালেন বোরো আবাদ পরিস্থিতি খুবই ভালো। বাম্পার ফলনের আশা করছি আমরা। বর্তমানে ধান ও চালের দাম বেশী। সেজন্য ধান আবাদে আর্থিকভাবে বেশী লাভবান হবো। তাদের কথা, গত বোরো ও রোপা আমন বন্যা, অতিবৃষ্টি, নি¤œচাপসহ নানা কারণে ধান ও চালের উৎপাদন ঘাটতি হয়।
দৈনিক ইনকিলাবের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ সংবাদদাতা রেজাউল করিম রাজু জানান, রাজশাহী জেলাগুলোর গ্রামগঞ্জে জমিতে ধানের চাষের অবস্থা ভালো। চাষিরা রোপা আমনে ভালো দাম পাওয়ায় বোরোতে ঝুকে পড়েছেন। প্রথমদিকে বীজতলা কিছুটা ঠাÐাজনিত সমস্যায় চারার ক্ষতি হলেও পুরো আবাদে কোন সমস্যা এখনো হয়নি। বরিশাল ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ সংবাদদাতা নাছিম উল আলম জানান, বরিশাল অঞ্চলে বোরোতে ১২৭% সাফল্য হয়েছে। আবাদ ও উৎপাদন খুবই ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নোয়াখালী ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ সংবাদদাতা আনোয়ারুল হক আনোয়ার জানান, নোয়াখালী অঞ্চলে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী জমিতে আবাদ হয়েছে। বগুড়া ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ সংবাদদাতা মহসিন আলী রাজু জানান, বগুড়া অঞ্চলে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায় বাম্পার ফলন হবে। ময়মনসিংহ ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ সংবাদদাতা শামসুল আলম খান জানান, ময়মনসিংহের মাঠে মাঠে বোরো ধান আবাদ চলছে পুরাদমে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার বেশী জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। দিনাজপুর আঞ্চলিক প্রধান মাহফজুল হক আনার জানান, দিনাজপুরেও বোরো ধানের আবাদ পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে এবার সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হবে।