ভালো থাকুক স্বপ্নগুলো ওপারে :আয়েশা আলম প্রান্তি
মেডিক্যালের পাঁচটা বছর কঠোর পরিশ্রমের পর কার্ড, আইটেম, টার্ম, প্রফ এসব পরীক্ষা পাস করে তারপর হতে হয় চিকিত্সক। নামের আগে চিকিত্সক উপাধি লাগানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা। ফাইনাল প্রফ অর্থাত্ শেষ পেশাগত পরীক্ষায় পাস করলেই ডাক্তার। তাই পরীক্ষাটা শেষ করে খুশিটা একটু বেশি থাকে। আর সেই খুশির সঙ্গে ছিল নেপালে বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার খুশি। সিলেটের জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজের সেই ১৩ জন নেপালি শিক্ষার্থী এরকম খুশি মনে বাড়ি যাচ্ছিল। তারা সবাই ১২ মার্চ প্রফের ছুটিতে বাড়ি ফিরছিল ইএস বাংলার (ফ্লাইট বিএস-২১১) বিমানে। বিমানটিতে যাত্রী ছিল ৬৭ জন, যার মাঝে ৩২ জন বাঙালি, ৩৩ জন নেপালি, ১ জন চীনা, একজন মালদ্বীপের নাগরিক। পাইলট আবিদ সুলতান ও ফার্স্ট অফিসার পৃথুলা সরকার ছাড়াও প্লেনটিতে ছিল চারজন বিমান ক্রু। দুর্ভাগ্যবশত নেপালি ৩৩ জনের মাঝে থাকা আমাদের এই ভবিষ্যত্ চিকিত্সকরা জানতেন না, এটাই হয়তো জীবনের শেষ বিমান যাত্রা। ১২ মার্চ ঢাকা থেকে রওনা হওয়া বিমানটি ২টা ২০ মিনিটে কাঠমন্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে নামার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ল। ঘটনাস্থলে নিহত হয় ৫০ জন মানুষ, গুরুতর আহত হওয়া বাকি সবাইকে নেপালের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সার জন্য নেওয়া হয়। রাগিব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজটির ১৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ঘটনাস্থলে নিহত হোন ১১ জন। নিভে গেল এতগুলো তাজা প্রাণের চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্ন। হলো না শেষবারের মতো বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা। তারা সবাই রাগিব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজের ফাইনাল প্রফ দেওয়া শিক্ষার্থী। গুরুতর আহত অবস্থায় নেপালে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন একই মেডিক্যালের শিক্ষার্থী প্রিন্সি ধামী ও সামিরা বেন্জাকর। শুধু রাগিব রাবেয়া মেডিক্যালের নয়, ঘটনাস্থলে নিহত হন আরও দুইজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। তারা হলেন কুমুদিনী মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শ্রেয়া ঝাঁ ও গোপালগঞ্জ শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যালের পিয়াস রায়। শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরা চিকিত্সক সমাজে। একসঙ্গে এতগুলো প্রাণ হারানো অত্যন্ত হূদয়বিদারক। রাগিব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজসহ প্রায় সবগুলো মেডিক্যাল কলেজে তিনদিন শোক পালন করা হয়। কালো ব্যাচ ধারণ, মোম বাতি প্রজ্জ্বলন, মিলাদ, দোয়া মাহফিল ইত্যাদি আয়োজন করা হয়।
রাগিব রাবেয়া মেডিক্যালের প্রিন্সিপাল আবেদ হোসেন জানান, ‘এ ক্ষতি অপূরণীয়। যাদের হারিয়েছি আমরা, তারা অত্যন্ত মেধাবী ছিল। হয়তো পাসও করে যাবে তারা, শুধু ডাক্তারি করাটা আর হবে না।’ কুমুদিনী মেডিক্যালের প্রিন্সিপাল ডা. আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমাদের শ্রেয়া ঝাঁ অনেক মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। তার এ অকালে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’
বিমান দুর্ঘটনার স্থান থেকে পাওয়া যায় পোড়া মেডিসিনের ডেভিডসনের বই, যা কাঁদিয়েছে দেশের হাজার মেডিক্যাল শিক্ষার্থীকে। পাওয়া যায় কারো কেনা গিফেটর প্যাকেট যার উপরে লেখা ছিল ‘ভালো লাগুক আর না লাগুক, প্লিজ পরে দেখো।’ হয়তো পরিবারের প্রিয় কারো জন্য উপহার নিয়ে যাচ্ছিল মেডিক্যাল পড়ুয়া ছোট মানুষটা। মানুষগুলো পুড়ে মরে গেল, রেখে গেল তাদের পরিবার আর স্বপ্নগুলো। কত আনন্দ নিয়েই না তারা ফেরত যাচ্ছিলেন। কল্পনায় হয়তো ভাসছিল বাবা-মায়ের মুখ, তাদের সঙ্গে দেখা হয় না কতদিন। হয়তো জড়িয়ে ধরে বলত, ‘পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। পাস হয়ে যাবে দেখো। ডাক্তার হয়ে যাব, ডাক্তার!’ পাস করলেই ডাক্তার—এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কি হতে পারত? তাদের সঙ্গে আরও অনেকে ছিলেন। কেউ হয়তো হানিমুন করতে, কোন চিকিত্সক দম্পতি ঘুরতে, কেউ কিছুটা সময় পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে কেউবা অন্য কোনো কাজে যাচ্ছিলেন। শেষ যখন বিদায় নিচ্ছিলেন কিংবা শেষ সেলফিটা যখন তুলেছিলেন, ভাবতে পেরেছিলেন, এই যাত্রাই শেষ যাত্রা! আর দেখা হবে না প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে! ইউএস বাংলার ফ্লাইট শুধু নিজেই বিধ্বস্ত হয়নি, বিধ্বস্ত হয়েছে অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন, হাসি, আনন্দ। চিকিত্সকের সাদা অ্যাপ্রন পরার বদলে সাদা কাফনের কাপড় পরে ফিরতে হলো তাদের বাড়ির পথে। আমাদের এই ভবিষ্যত্ চিকিত্সকদের চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্নটাও অপূর্ণ রয়ে গেল। যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক তারা।