মাতাল সমীরণে: রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ
মায়াবী মুখ। দেখলেই মনে হয়, কত দিনের চেনা। তার অভিনয়ে চরিত্রগুলোও বাস্তব হয়ে ওঠে। জাকিয়া বারী মম তাই হয়ে উঠেছেন লাখো দর্শকের প্রিয় অভিনেত্রী। ছোট পর্দার পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সাফল্যের ছাপ। এ অভিনেত্রীকে নিয়ে লিখেছেন রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ
কষ্টের প্রকাশ এমন ছিল, যা দেখে অনেকের চোখ হয়ে উঠেছিল জল-টলমল। জানতেন, এটা নিছক এক গল্প; আর অশ্রুসিক্ত তরুণী যা বলছেন, তা শিখিয়ে দেওয়া সংলাপ। কিন্তু তার মায়াবী মুখ সে কথা বিশ্বাস করতে দেয়নি। এর দু’দিন পরই আবার যখন সেই তরুণীর দেখা মিলল, তখন তার বিরহে কেউ কাতর হলো না। বরং তার কাণ্ডকারখানা দেখে সবাই হেসে অস্থির। কারণ এদিন এই অভিনেত্রীর মাঝে দর্শক খুঁজে পেয়েছে অন্য একজনের ছায়া। এভাবেই ‘নীল চুড়ি’, ‘একটি স্যুটকেস এবং’, ‘ভালোবাসার অপূর্ণতা’, ‘মেয়েটি কথা বলিবে প্রেম করিবে না’, ‘এক্লিপস’, ‘হলুদ বসন্ত’, ‘নীল দুপুর’, ‘লুকোচুরি’, ‘ভালোবাসার চতুস্কোণ’, ‘মায়ের জন্য’, ‘নীলপরী নীলাঞ্জনা’, ‘দ্বিতীয় কুসুম’, ‘আবর্ত’, ‘আশার আলো’, ‘পদ্মবিবির পালা’, ‘তোমার জন্য এক পৃথিবী’, ‘ঝামেলা আনলিমিটেড’সহ অসংখ্য নাটক, টেলিছবি এবং ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কখনও তিনি দর্শককে কাঁদিয়েছেন, হাসিয়েছেন; কখনও আবার প্রিয়জনের ছায়া হয়ে কড়া নেড়েছেন মনের দরজায়। সেই সুবাদে নানা রূপে, নানা চরিত্রে দর্শকের সামনে আসা জাকিয়া বারী মম নামের সেই তরুণী হয়ে উঠেছেন লাখো মানুষের প্রিয় অভিনেত্রী। অনবদ্য অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এর বাইরেও স্বীকৃতি, সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। অবশ্য এসব খবর অনেকেরই জানা। এক যুগ ধরে যিনি অভিনয় করছেন, তার অভিনয় সম্পর্কেও আলাদা করে বলার কিছু নেই। তার পরও মম’র কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নিজের স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে যার মিল নেই এমনকি যাদের যাপিত জীবন কাছে থেকে দেখারও সুযোগ হয়নি; তাদের চরিত্রগুলো অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন কীভাবে? এর উত্তরে মম বলেন, ‘আমরা কেউ সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে পরিচিত নই। কারও জীবনযাত্রা কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, কারও শুধু বাইরের রূপটাই ধরা দিয়েছে। যে জন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয় সব ধরনের চরিত্র সমানভাবে বাস্তব করে তোলা। একটা সময় পরিচালকের কথায় চরিত্র যতটুকু বুঝে নেওয়া যায়, তা বুঝে ও নির্দেশ মেনে অভিনয় করতাম। আর এভাবে কাজ করতে গিয়ে এক সময় বুঝতে পারলাম, একটা স্ট্ক্রিপ্টে গল্পের যে ঘটনা বা সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে, তার আরও গভীরে যাওয়া যায়। মানুষের উপলব্ধি কত রকমের হতে পারে, তা নিজের অতল হাতড়েও খুঁজে পাওয়া যায়। এটা যখন বুঝেছি, তখন থেকে চেষ্টা করছি চরিত্র যতটা সম্ভব বাস্তব করে তুলে ধরার।’
মমর কথায় সহজেই বোঝা যায়, চরিত্রের গভীরে গিয়ে তার আসল অবয়বটা তুলে আনেন তিনি। হয়তো এ কারণেই মম তার সমকালীন শিল্পীদের থেকে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরতে পেরেছেন। এক যুগ ধরে সমান্তরালভাবে কাজ করে কখনও হোঁচট খেতে হয়নি তাকে। তার পরও আগের তুলনায় মমকে আজকাল ধারাবাহিক নাটকে খুব কম দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী?
জবাবে মম একটু মজা করেই বললেন, ‘ধারাবাহিক নাটক তো ধারাবাহিকতাই ধরে রাখতে পারছে না। খেয়াল করলে দেখবেন, নাটকের শুধু কাহিনীর শাখা-প্রশাখাই বাড়ে, কোনো পরিণতির দিকে যায় না। বেশির ভাগ নাটকের একই অবস্থা। নাটকে অভিনয় করে যদি জানতেই না পারি এর কাহিনী কোন দিকে মোড় নেবে, তাহলে বুঝব কেমন করে তা দর্শকের ভালো লাগবে কি-না। সে কারণে দীর্ঘ ধারাবাহিকের পরিবর্তে একক নাটক ও টেলিছবিতে বেশি কাজ করছি।’
কী সহজ স্বীকারোক্তি! মমর মতো এভাবে সোজাসাপ্টা কথা ক’জন বলেন, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। অবশ্য সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই বলে থাকেন, মমর মধ্যে লুকোছাপা নেই। সে হিসেবে ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় কমিয়ে দেওয়া নিয়ে মম যা বললেন, তা মিথ্যা বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। নাটকের কথা নাই হলো। কিন্তু চলচ্চিত্রে সাফল্য পেলেও সেখানে তার অনুপস্থিতি কম কেন? মম বলেন, ‘নাটক, টেলিছবি, চলচ্চিত্র, যা-ই বলুন; কাহিনী, নির্মাণ ও অভিনয় ভালো না হলে দর্শক তা মনে রাখে না। চলচ্চিত্রে বেশি কাজ করলেই দর্শক আমাকে মনে রাখবে- এ কথা বিশ্বাস করি না। সংখ্যা নয়, দর্শক মনে রাখে ভালো কাজের কথা। এ জন্য আমি চাই যে ধরনের ছবির গল্প দর্শকের মনে দাগ কাটবে তেমন কিছু ছবিতে অভিনয় করতে। ভালো ছবির জন্য অপেক্ষায় থাকতেও আমার আপত্তি নেই।’
মমর এ কথায় বোঝা যায়, জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যে কোনো কাজে তার আগ্রহ নেই। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি। বাছ-বিচার করে যখন কাজ করেন, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে তার সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র ‘আলতা বানু’ কিছুটা হলেও ভিন্ন ধরনের। সে কথা স্বীকার করেছেন মম নিজেও। তিনি বলেন, ‘এ সময়ের অনেক ছবি থেকে এর গল্প ও চরিত্র আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা মনে হয়েছে। ওই যে বললাম, ভালো ছবির জন্য অপেক্ষায় থাকতেও আপত্তি নেই। ‘আলতা বানু’ তেমনই এক গল্পের ছবি। ফরিদুর রেজা সাগরের লেখা ‘আলতা বানু’ গল্প পড়ে ভালো লেগেছে বলেই অভিনয়ে রাজি হয়েছি। আর অরুণ চৌধুরী অনেক দিন ধরে নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। নির্মাণে সে অভিজ্ঞতার ছাপও আছে।’ এ ছবির পর শিহাব শাহীনের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আনারকলি’তে মমকে দেখা যাবে। শিগগিরই শুরু হবে এ ছবির কাজ।
কাজের কথা অনেক হলো, এবার জানতে চাই, অভিনয়ের বাইরে যে সময়টা একান্ত নিজের, সে সময়ে কী করেন? উত্তরটা মম একটু অন্যভাবে দিলেন- ‘অবসর আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে রাখে। কখনও তাই নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবনার অতলে ডুব দিই। ছুটে যেতে ইচ্ছে সাগরপাড়ে কিংবা পাহাড়চূড়ায়। কাব্যকথায় মনে মনে বলি, ছুঁয়ে যাক মাতাল সমীরণ, হোক না পবনে নিমজ্জন…।’
এ কথা বলার পর মনে হলো ঘোর ভাঙল তার। বললেন, ‘একান্ত নিজের সময়গুলো যে কেমন, তা আসলেই বলে বোঝানো যাবে না। সেই যাই হোক, কাজের অবসর যেমন ভালো লাগে তেমনি কাজে ডুবে থাকতেও ভালোবাসি। কাজ নিয়ে আমার কোনো ক্লান্তি নেই। কারণ অভিনয় জগৎকে অসম্ভব ভালোবাসি। যে মমকে সবাই চেনেন, ভালোবাসেন- তা এই অভিনয়ের জন্য। তাই সবকিছুর পরও অভিনয়ের সঙ্গেই থাকতে চাই।’