স্টিয়ারিং হাতে আত্মবিশ্বাসী নারী

বিয়ের পৌনে তিন বছরের মাথায় হঠাৎ হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যান রংপুরের পীরগঞ্জের শারমিনা আক্তার বাণীর। অনেক চেষ্টা করে শ্বশুরবাড়িতে টিকতে না পেরে সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। বাবা অসুস্থ, ছয় ভাই-বোনের সংসারে ছেলেকে নিয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়ান শারমিনা। নিজের খরচ চালাতে বাবার বাড়ির এলাকায় ব্র্যাকের শিক্ষা প্রোগ্রামে লাইব্রিয়ান হিসেবে চাকরি নেন। পরে ২০১২ সালের শেষের দিকে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরির পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এফএওতে গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। ৪৫ হাজার টাকা মাসিক সম্মানী এবং ট্যুরের আলাদা বিলসহ ভালো বেতন পাচ্ছেন। ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালো আছেন ৩০-ঊর্ধ্ব শারমিনা।

শারমিনার মতো অনেক নারী বর্তমানে পেশা হিসেবে গাড়ি চালনায় যুক্ত হচ্ছেন। পেশাদার ও অপেশাদার দুভাবেই গাড়ি চালনায় এগিয়ে আসছেন তারা। শুধু শখের বশে গাড়ি চালনা নয়, নারীরা এখন এ পেশায় যোগ দিচ্ছেন জীবিকা অর্জনের জন্য। চাকরি পেতেও সমস্যা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ, ব্র্যাক, কেয়ার বাংলাদেশ, নেসলে, এফএওসহ বেশকিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় নারী চালক রয়েছেন। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর জন্য নারী চালকের চাহিদা বাড়ছে।

ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের ট্রেনার অ্যান্ড ইনচার্জ অনারারি ক্যাপ্টেন (অব.) মো. আব্দুল কুদ্দুস বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের কাছ থেকে সাধারণত এনজিও থেকে নারী ড্রাইভার চাওয়া হয় বেশি। তবে ইদানীং ব্যক্তিগত গাড়িচালক হিসেবে নারীর চাহিদা বাড়ছে। নারীরা খামখেয়ালি কম করেন, ঠাণ্ডা মাথায় নিয়ম মেনে গাড়ি চালান বলে অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ির জন্যও নারী চালক খুঁজছেন। নারীরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান না বলে দুর্ঘটনা খুব একটা হয় না।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত ২৪ হাজার ২২৫ জন নারী চালক লাইসেন্স নিয়েছেন। এর মধ্যে অপেশাদার লাইসেন্স নিয়েছেন ২৩ হাজার ৫২২ জন নারী। আর পেশাদার নারী চালক হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছেন ৭০৩ জন। পেশাদার নারী চালকের মধ্যে ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স নিয়েছেন ১৪ জন। মাঝারি মানের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ১৮, হালকা যান (জিপ, কার, মাইক্রোবাস) ৬১৩ জন এবং টু হুইলার চালনার লাইসেন্স নিয়েছেন ৫৮ জন নারী।

দিনাজপুরের হরিনাথপুরের সাঁওতালপল্লী ফরিদাবাদের মেয়ে রাজিনা বেশরার। ২৪ বছর বয়সী রাজিনা ছোটবেলা থেকেই অন্যান্য নারীর মতো কৃষিকাজ করতেন। যে হাত দিয়ে ধানের চারা রোপণ করতেন, ধান কেটেছেন, সেই হাতে আজ গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে নিয়েছেন তিনি। এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর পরিবার, এলাকাবাসী সবার বাধা অগ্রাহ্য করে ঢাকায় এসে ড্রাইভিং ট্রেনিং নেন। আজ তার তিন মাসের ট্রেনিং শেষ হবে। এরই মধ্যে পেশাদার লাইসেন্সের জন্য বিআরটিএতে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। লাইসেন্স পেলে কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর প্রত্যাশা তার। একই আত্মবিশ্বাস কিশোরগঞ্জ সদরের পূর্ব তারাপাশা গ্রামের সানজিদা খানের চোখে। উত্তরার আশকোনায় অবস্থিত ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে নিতে চাই।

পুরুষ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন খাতে নারী প্রবেশের কারণে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয় কিনা তা দেখতে ২০১২ সালে ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ব্র্যাক। সেখানে নারী পেশাদার ড্রাইভার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি থেকে এখন পর্যন্ত ১৭০ জন পেশাদার নারী ড্রাইভার ট্রেনিং নিয়েছেন।

ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসেন বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা গাড়ি চালানোর সময় ঝুঁকি নেন না। তারা ধৈর্যসহকারে গাড়ি চালান। ফলে দুর্ঘটনা কম হয়।

তবে এ পেশায় আসা নারীদের মতে, দেশের সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত কারণে ড্রাইভিং পেশায় এখনো মেয়েদের কাজ করার পরিবেশ পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এ পেশায় মেয়েদের সংখ্যা আরো বাড়লে পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চিত্রনায়ক ও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, কোনো পেশাই নারীবান্ধব নয়, পেশাকে নারীবান্ধব করে নিতে হয়। বেশিসংখ্যক নারী ড্রাইভিং পেশায় এলে এটিও নারীবান্ধব হবে। নারীরা রাস্তায় প্রতিযোগিতা কম করেন, নিয়ম মেনে চলেন। সে কারণে নারীরা যদি ড্রাইভিং পেশায় একটু বেশি আসেন, তাহলে দুর্ঘটনা কম হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য