ভুল বার্তাই দুর্ঘটনার কারণ! পরস্পরকে দুষছে বিমানবন্দর ও এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ

নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ৫০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বৈমানিক আবিদ সুলতান। এদিকে দুর্ঘটনা নিয়ে চলছে দোষারোপের খেলা। কাঠমান্ডু এয়ার ট্রাফিক কণ্ট্রোল বা এটিসি জানিয়েছে, ইউএস বাংলার পাইলটের ভুলের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের কোনও ভুল ছিল না বলে মনে করছেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগে ত্রুটি বা তাদের ভুল বার্তার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।  তবে গতকাল পর্যন্ত ক্যাপ্টেনের কোনও  দোষ  আমরা খুঁজে পাইনি। সোমবার নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ৪ ক্রুসহ ৭১ আরোহীসহ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।

 

দুর্ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল গতকাল নেপাল পৌঁছেছেন। পাশাপাশি ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে নিহতদের ৩৮ জন স্বজনও সেখানে গেছেন। পোস্টমর্টেমসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে তাদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন ইউএস-বাংলার জিএম (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম।

 

এদিকে ঘটনা তদন্তে নেপালে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে প্লেনটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ হিসেবে সেখানকার বিমানবন্দরের ভুলকেই সন্দেহ করা হচ্ছে। ডাটা রেকর্ডার নিয়ে তদন্তের পর এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। তদন্তের শুরুতেই গতকাল দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষকারী  ৬ কর্মীকে কন্ট্রোল রুম (কাঠমান্ডু এটিসি) থেকে সরিয়ে নিয়েছে ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। নেপালি সংবাদমাধ্যম ‘মাই রিপাবলিকা’র খবরে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

 

তদন্ত শুরু: নেপালে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলার বিএস-২১১ ফ্লাইটের সংগৃহীত ডাটা রেকর্ডার নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরের জেনারেল ম্যানেজার রাজ কুমার ছেত্রী। নেপালের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। রাজ কুমার ছেত্রী জানিয়েছেন, ইউএস-বাংলার ফ্লাইটটির ধ্বংসাবশেষ থেকে ডাটা রেকর্ডার উদ্ধার করা হয়। এটি তাদের কাছে নিরাপদে রাখা হয়েছে। প্লেন বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ জানতে সোমবার  রাতেই ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নেপাল সরকার। নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক মহাপরিচালক যজ্ঞ প্রসাদ গৌতমের নেতৃত্বে এ কমিটি কাজ করবে। গতকাল  সকাল থেকেই কমিটি কাজ শুরু করেছে।  নেপালি মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখছে বলে জানানো হয়েছে।

 

নেপালের বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সানজিব গৌতম বলেন, বিমানটির পাইলটকে বিমানবন্দরের দক্ষিণ-প্রান্ত থেকে রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের উত্তর অংশ থেকে বিমানটি অবতরণের চেষ্টা করে পাইলট। এ সময় হঠাত্ বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। পরে বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি।

 

৬ কর্মীকে  সরিয়ে নেয়া হয়েছে: ইউএস বাংলার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা প্রত্যক্ষকারী  ৬ কর্মকর্তাকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সরিয়ে নিয়েছে নেপালের বিমান কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনাজনিত শোক থেকে বের করে আনার জন্য তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন নেপালের বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক রায়হান পোকহারেল। তবে এমন এক সময় তাদের সরিয়ে নেওয়া হলো, যখন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যোগাযোগগত ত্রুটির জোরালো অভিযোগ উঠেছে। ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষের ধারনা, কন্ট্রোল রুমের ভুল বার্তাই দুর্ঘটনার কারণ।

 

পাইলটের ভুল ছিল না: নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের কোনও ভুল ছিল না বলে মনে করছেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। গতকাল মঙ্গলবার ইউএস বাংলার জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাপ্টেনের কোনও প্রবলেম আমরা আসলে খুঁজে পাইনি।

 

ঘটনার পরপরই এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স ও ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দাবি, পাইলটের ভুলেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আর ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছিলো তাদের। সর্বশেষ নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনেও ইউএস বাংলার দাবির সত্যতা মিলেছে।

 

এর পরিপ্রেক্ষিতে কামরুল ইসলাম বলেন, কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনের যে অডিও বের হয়েছে, সেখানে কন্ট্রোল টাওয়ারের কিছু মিস-গাইডেন্স দেখেছি আমরা। তদন্তের পর সঠিক কারণ পুরোপুরি বলতে পারবো। প্রাথমিকভাবে আমরা বুঝতে পেরেছি ক্যাপ্টেনের এখানে কোনও দোষ নেই। কারণ তার ৭ হাজার ঘণ্টারও বেশি ফ্লাইট পরিচালনা এবং ওই এয়ারপোর্টে শতাধিক ল্যান্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে।

 

নেপালে বিমানমন্ত্রী:বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল গতকাল সকাল সোয়া ১১ টার দিকে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালককে (অপারেশন এন্ড ফ্লাইট সেফটি) সঙ্গে নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর একটি নিয়মিত ফ্লাইটে  নেপালে যান। তিনি সেখানে নেপাল ও বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর ও আহতদের অবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এরপর মন্ত্রী দেশটির নরভিক হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ইয়াকুব আলীকে দেখতে যান। পরে সন্ধ্যায় নেপাল সিভিল এভিয়েশনের একটি ব্রিফিংয়ে অংশ নেন।

 

নিহতদের দেশে আনার খরচ বহন করবে ইউএস বাংলা: বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ দেশে আনা ও আহতদের চিকিত্সা বাবদ সকল খরচ ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ বহন করবে বলে গতকাল সংস্থার জনসংযোগ মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি রাতে ইত্তেফাককে জানান, সব প্রক্রিয়া শেষ করে মরদেহগুলো দেশে ফিরিয়ে আনতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগবে।

 

কাঠমান্ডু থেকে যেভাবে লাশ ঢাকায় আসবে:নেপালে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন তাদের স্বজনরা। তবে লাশগুলোর অবস্থা বিকৃত হয়ে পড়ায় শনাক্তকরণে সমস্যা হচ্ছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে বাংলাদেশিদের লাশ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, শনাক্ত করার পর ইউএস বাংলা নিজস্ব খরচে লাশগুলো ঢাকায় নিয়ে আসবে। তবে ঢাকায় পাঠানোর সময় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, কাঠমান্ডু পুলিশের রিপোর্ট, দূতাবাসের রিপোর্ট -এই তিনটি কাগজ অবশ্যই লাগবে। তবে এসব রিপোর্ট পেতে কোনও সমস্যা হবে না। নেপাল ও বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বিমানের  বাংলাদেশের ৩২  যাত্রী ও চার ক্রুয়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত তাদের কাছে ১০ জনের বেঁচে থাকার তথ্য আছে। ২৬ জন মারা গেছেন। মৃতদের লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় শণাক্তকরণ জটিল হয়ে পড়েছে। অন্য প্রক্রিয়ায়  নিহতদের শণাক্ত করার  চেষ্টা চলছে।
এ বিভাগের অন্যান্য