পর্যটনের অপার সম্ভাবনা কোম্পানীগঞ্জের ‘উৎমা ছড়া’
সিলেটের সময় ডেস্ক :
চোখ যতদূর যায় ডানে, বামে ও সামনে সারি সারি উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। এ পাহাড়ের বুকে গাঢ় সবুজের আস্তরণ। আকাশ যেনো হেলান দিয়ে আছে পাহাড়ের বুকে। পাহাড়ের বুক চিড়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ঝর্ণার শীতল স্বচ্ছ জলরাশি বয়ে চলছে সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জের উৎমা ছড়া দিয়ে।
এ ছড়ার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় বিভিন্ন রংয়ের অসংখ্য অগণিত পাথর। এ যেনো ছোট বড় পাথর ও স্বচ্ছ জলের মিশ্রিত বিছানা।
সবুজ পাহাড় ঘেঁষা আকাশের নীলের ছায়া ও সাদা সাদা মেঘের খেলা। এমন এক সৌন্দর্য যা স্বচক্ষে না দেখলে বর্ণনা দিয়ে ভ্রমণ পিপাসুদের মনের পিপাসা মিটানো সম্ভব না। এ স্থানকে সিলেটের নতুন ‘পর্যটন কেন্দ্র’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের চরারবাজার সীমান্তে। রূপ-লাবণ্যে যৌবনা উৎমাছড়া পরতে পরতে সাজিয়ে রেখেছে সম্মোহনী সৌন্দর্য। যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্ত নির্জন অরণ্যের সাহচর্য পেতে উৎমাছড়ার বিকল্প নেই। আছে সবুজের সমারোহ, দিগন্ত বিস্তৃত সাদা মেঘের খেলা, পাথর ছড়ানো চারপাশ, দুধসাদা জলরাশি, পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশির কলতান, পাখির কিচিরমিচির। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই প্রকৃতি প্রেমীদের।
উৎমাছড়া ভ্রমণের শ্রেষ্ট সময় বর্ষাকাল। বছরের এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর মাসের যে কোন দিন উৎমাছড়া ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের সর্বোৎকৃষ্ট দিন।
প্রকৃতি কন্যা সিলেটের সৌন্দর্য্যটা আসলে বর্ষাকালেই বেশী উপভোগ করা যায়। আর তা ছাড়া বর্ষার সময়ে উৎমাছড়ার নদের স্বচ্ছ জল, গাঢ় সবুজের পাহাড় ও আকাশে মেঘের ছুটাছুটি এখানের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেয়।
দেশের ৬১ জেলা ভ্রমণকারী বাইকার ডা. আব্দুল আওয়াল দৈনিক সিলেট’কে বলেন, আমি বাংলাদেশের ৬১টি জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ করেছি। সারা দেশের তুলনায় সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো একটু বেশিই সুন্দর। তার মাঝে কোম্পানীগঞ্জের উৎমাছড়া একটু ভিন্ন রকম সুন্দর। পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশির ঝর্ণা পাথরের বুক বেদ করে উৎমাছড়া নদের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পাহাড় ও আকাশ একত্রে মিশে যায়, এ সৌন্দর্য আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, তা স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বুঝবেন না। তবে এই পর্যটন কেন্দ্রের প্রচার প্রচারণা না থাকায় ভ্রমণ পিপাসুরা এখানে আসে না। এই স্থানটিকে প্রচার-প্রচারণা করা হলে সিলেটের মধ্যে অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে এতে এই এলাকার মানুষের কিছু কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি সরকার বিপুল পরিমাণের রাজস্ব পাবে বলে আমি মনে করি।
স্থানীয় ভ্রমন প্রেমী বিজয় পাড়ুয়া গ্রামের সুমিত সিংহ জানান, উৎমাছড়া এলাকায় এক সময় পাথর কোয়ারি ছিল। এখানে হাজার হাজার শ্রমিক, ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থান ছিল। বর্তমানে এলাকার মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে দিশেহারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। পাথর উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে হাইকোর্টের আদেশে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় উৎমাছড়া নতুন রূপে সেজেছে। স্থানীয় মানুষজন এখানে এসে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে আনন্দ উল্লাস করে। উৎমাছড়ার সৌন্দর্যের প্রচার-প্রচারণা করা হলে সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে ঘুরতে আসবে। সৌন্দর্যপূর্ণ এই স্থানকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোঘনা করা হলে পর্যটকদের আগমণে স্থানীয়দের কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমি মনে করি।
কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক কবির আহমদ জানান, উৎমাছড়ার অপরূপ সৌন্দর্যে স্থানীয় মানুষ মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণ করতে আসেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এখানে আসার প্রধান সড়ক কলাবাড়ী সেতু থেকে উৎমাছড়া (চরার বাজার) এর রাস্তা খুবই খারাপ থাকায় দূর-দূরান্তের পর্যটকেরা আসতে পারে নাই। এ বছর স্থানীয় সাংসদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদের বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা ব্যায়ে নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এখন প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যটন সংশ্লিষ্টদের প্রচার-প্রচারণায় এই স্থানটি হয়ে উঠতে পারে সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার ফলে সিলেট সহ সারা দেশ থেকে আসা পর্যটকেরা সহজেই এই মনোমুগ্ধকর অপরূপ সৌন্দর্যপূর্ণ স্থানটি ভ্রমণ করতে পারবেন।
সিলেট ট্যুরিজম ক্লাবের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. সোহেল রানা বলেন, উৎমা ছড়া একটি মনোরম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্পট। সিলেটের পর্যটন ক্ষেত্রে উৎমা ছড়ার রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সংশ্লিষ্ট ঊধ্বর্তনরা পরিকল্পনা করে সাজালে এটাও সাদা পাথরের মত পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, উৎমাছড়া এলাকাটি অপরূপ সুন্দর। যা দেখলে যে কোন বয়সের মানুষের হৃদয়ে প্রশান্তি আসবে। উৎমাছড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আমি গিয়েছি কয়েক বার। এই স্থানটি কে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে উপজেলা প্রশাসনের। সিলেট থেকে উৎমাছড়া যাওয়ার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। উৎমাছড়া এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়াতে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষনার আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যেই বিজিবির একটি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি দ্রæত সময়ের মধ্যেই বিজিবির ক্যাম্পটি হয়ে যাবে। এটি হয়ে গেলেই উৎমাছড়া এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষনা করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রচার-প্রচারণা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সিলেট-৪ আসনের সাংসদ ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ মহোদয় কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা করেছেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর হয়ে উৎমাছড়া টু বিছনাকান্দি ও জাফলংয়ে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতি মধ্যেই এ সড়ক যোগাযোগের তৈরি করার জন্য একটি সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হলে সড়ক নির্মাণে কাজ শুরু হবে। এতে করে সারাদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা এক দিনেই সাদা পাথর, উৎমাছড়া, বিছনাকান্দি ও জাফলং পর্যটন কেন্দ্র খুবই সহজে ভ্রমণ করতে পারবেন।