• তালাক আবেদন ও কার্যকরের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
  • ৪ বছর আগের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছেদ প্রায় দিগুণ।
  • অধিকাংশের বয়স ২২ থেকে ৩০ এবং উচ্চ শিক্ষিত।

সিলেট নগরীর সুবিদ বাজারের বাসিন্দা সাইমা ওয়ালিদ (ছদ্ম নাম) বয়সে দেড় বছরের ছোট আপন খালাত ভাই ফাহিম তালুকদার (ছদ্ম নাম) কে বিয়ে করেছিলেন ২০০৮ সালে। পরিবারের ইচ্ছা আর নিজের ভালোবাসার সমন্বয়েই হয়েছিলো বিয়ে। বয়সে দেড় বছরের ছোট আপন খালাত ভাইকেই বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু নানা কারণে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে গত ২৬ আগস্ট স্বামীকে তালাক দিতে হয় তার। তবে স্বামী ফাহিম তালুকদার বললেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান তার স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার কারণে তাকে তালাক দিয়েছেন।

কেবল সাইমা ওয়ালিদ আর ফাহিম তালুকদারের এ তালাকের ঘটনাই নয়। সিলেট নগরীতে ঘটছে অসংখ্য বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের ঘটনা। বিশেষ করে গত ৪ বছর থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে নারী কর্তৃক তালাকের আবেদনই বেশি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মাধ্যম থেকে জানা গেছে। আর তালাক আবেদনকারী অধিকাংশের বয়স ২২ থেকে ৩০ এবং উচ্চ শিক্ষিত। পারিবারিকভাবে অধিকাংশই উচ্চবিত্ত।

পারিবারিক কোর্ট বা স্বামী-স্ত্রীর সমন্বয়ে পারিবারিকভাবেই কাজী কর্তৃক অধিকাংশ তালাক হওয়ার কারণে এর অধিকাংশ তথ্য পাওয়া সম্ভব না হলেও সিলেট সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত গত ৪ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্তই বিবাহ বিচ্ছেদ (তালাক) আবেদন করেছেন ১৬৫ জন। যার ৯৫ জন নারী আর ৭০ জন পুরুষ। চলতি বছরে ইতোমধ্যে তালাক কার্যকর করা হয়েছে ২০টি। ২০১৮ সালে পুরো বছরে মোট আবেদন করেছিলেন ২৫৫ জন। যার ১৭১ জনই নারী আর ৮৪ জন ছিলেন পুরুষ। এর মধ্যে কার্যকর হয়েছিলো ২৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ। কিন্তু এ বছর ৯ম মাসে এসেই কার্যকর হয়েছে ২০টি। এখনো অধিকাংশ আবেদনের শোনানি বাকি থাকায় কার্যকর তালাকের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হতে পারে বলে ধারণা সিসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার।

এর আগে ২০১৭ সালে তালাকের আবেদন করেছিলেন ২২০ জন। যার ২০টি তালাক কার্যকর করা হয়। এছাড়া ২০১৬ সালে তালাকের আবেদন হয়েছিলো ২০৭ টি। কিন্তু কার্যকর হয়েছিলো মাত্র ১০ টি তালাক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর তালাক আবেদন ও কার্যকরের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

এছাড়াও অকার্যকর তালাকের আবেদনগুলো হয় বিভিন্নজনের হস্তক্ষেপে ফের সংসার করছেন না-হয় সিসিকের নোটিশ আমলে না নিয়েই নিজ উদ্যোগে তালাক কার্যকর করেছেন বলেও মন্তব্য করলেন সিসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

বিশেষজ্ঞদের মতে সাংসারিক বন্ধনের প্রতি উদাসীনতা, নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নারী-পুরুষের উচ্চাভিলাষী মনোভাব, স্বার্থগত মনোভাব, লোভ, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির প্রভাব, বেকারত্ব থেকে সৃষ্ট সমস্যা, স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি অসম্মান, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, পরকীয়াসহ ইত্যাদি কারণকে দিন দিন মানুষের মাঝে বিচ্ছেদ বাড়ছে।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত কয়েক বছর থেকে তালাক আবেদন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে নারীরাই বেশি আবেদন করছেন। মূলত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মানুষ দূরে চলে যাওয়ায় দিন দিন মানুষের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। এসব বিষয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি যতটুকু সম্ভব একে অপরের সাথে মিলে মিশে চলা, স্বামী-স্ত্রীর সম্মান ও ভালোবাসার জায়গা বজায় রেখে চলা, বাবা-মাও যদি ছেলে মেয়েদের সংসার সুখে রাখার ক্ষেত্রে সহযোগী হয়ে চলেন তাহলে বিচ্ছেদের প্রয়োজন হবে বলে আমার মনে হয় না। তাই কোন আবেদন হলে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সময় দিয়ে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে একত্রে করার চেষ্টা করি। আমার অনুরোধে সকল মানুষ যেন নিজের সংসারের প্রতি মনযোগী হয় এটাই প্রত্যাশা করি।’

সিসিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন সময়ে তালাক কার্যকর হওয়া ১০ জন নারী ও ১০ জন পুরুষ মিলে মোট ২০ জনের সাথে ফোনে কথা বলে জানা গেছে কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই সুখে নেই। কেউ কেউ নতুন করে বিবাহ করলেও কয়েকজন আছেন এখনো একা। তবে কয়েকজন আগের তুলনায় সুখে আছেন বলেও জানা গেছে। এদের সাথে কথা বলে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল, কলহ, নির্যাতন, পরকীয়া এমনকি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর পিতা-মাতার খারাপ আচরণের বিষয়টিও উঠে এসেছে।

তবে এটা নিয়ে চিন্তিত গবেষকরাও। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট এসোসিয়েশনের সদস্য, মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সাইদ ইনাম ওয়ালিদ বলেন- বিচ্ছেদ যে ভাবেই হোক এর সুফল খুব ভালো হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে মানুষ সুখী হলেও অধিকাংশই পরবর্তী জীবনে ভোগতে হয়। এমনকি কোন কোন সময় মানুষ দেখতে সুস্থ হলেও মনরোগ দেখা দেয়। যার ফলে দেখা দেয় সমস্যা। এমনকি একটি বিচ্ছেদ পুরো পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে। কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তানও বড় হয় ব্রোকেন পরিবারে। সন্তানের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়।

তিনি বলেন, যে সংসারে আছি ভালো আছি আর ভালো থাকার চেষ্টা করি এই মনোভাব থেকে স্বামী-স্ত্রী মানিয়ে চলাটাই মুখ্য ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি যত্নশীল হওয়া, সৎ থাকা, সংসারের প্রতি মনোযোগী হওয়া, একে অপরকে বোঝানো, সংসার গঠনে বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া ইত্যাদি মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যেতে পারে বলে মত দিলেন এ বিশেষজ্ঞ।