মেসির লাল কার্ড নিয়ে বিতর্ক

ক্রীড়া ডেস্ক: লিওনেল মেসি লাল কার্ড দেখেছেন। হ্যাঁ আপনি, ঠিকই পড়েছেন। প্যারাগুইয়ান রেফারি মারিও ডিয়াজ তাই হয়ে গেছেন ম্যাচের ‘নায়ক’। অথচ ম্যাচটা ছিল তৃতীয় স্থান নির্ধারনী। শুধুই সান্ত্বনার। সেই ম্যাচ পরিণত হলো একরকম ‘যুদ্ধে’। শুরু থেকে আঁচ বোঝা যাচ্ছিল। ৩৭ মিনিটে বোঝা গেল রেফারি নিজেও হয়ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন ম্যাচের। মেসি আর চিলি অধিনায়ক গ্যারি মেডেল দুইজনই দৌড়াচ্ছিলেন বলের পেছনে। মেডেল সামনে, পেছনে মেসি। বল বাইলাইন অতিক্রম করেছে, রেফারিও গোলকিক দিয়েছেন চিলিকে। কিন্তু পেছন ঘুরে মেডেল তেড়ে গেলেন মেসির দিকেই। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক প্রথম চেষ্টায় মুখ সরিয়ে গা বাঁচালেন, পরের দফায় নিজেও একটু জড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু সেটা আর যাই হোক লাল কার্ড দেখানোর মতো অপরাধ ছিল কী না সেটা নিয়ে বিতর্ক খুব তাড়াতাড়ি বোধ হয় ফুরোবে না। রেফারি দৌড়ে এসে সরাসরি প্রথমে মেডেলকে দেখালেন লাল কার্ড, একটু পর মেসিকেও। কোপা আমেরিকার তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচও তাই বিতর্ক উস্কে দিয়েছে নতুন করে। ম্যাচের স্কোরলাইনটাই তাই ছাপিয়ে গেছে ওই ঘটনা। লাল কার্ড ড্রামার আগেই আর্জেন্টিনা এগিয়ে গিয়েছিল দুই গোলে, এরপর দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে এক গোল শোধ করেছিল চিলি। শেষ পর্যন্ত তাই ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে কোপায় তৃতীয় হয়েছে আর্জেন্টিনা।

দুই লাল কার্ড বাদ দিয়ে পুরো ম্যাচে আরও সাতটি হলুদ কার্ড দেখিয়েছেন রেফারি। ম্যাচে মোট ফাউল হয়েছে ৩৭ টি। ব্রাজিলের কাছে হারের পর ভিএআর নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক মেসি। চিলির সঙ্গে ম্যাচের আগেও ঘুরে ফিরে সেই বিতর্কই চলছিল। এবার বোধ হয় তাতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে অভিষেকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছিলেন মেসি। ১৪ বছর পর দেখলেন দ্বিতীয়টি। টিভি রিপ্লেতে অবশ্য ওই ঘটনার সময় মেসির দোষ বুঝা যায়নি। সরাসরি লাল কার্ড হওয়ায় ভিএআরও বদলাতে পারত রেফারির সিদ্ধান্ত। কিন্তু তেমনটি আর হয়নি। প্রায় মিনিট পাঁচেক দুই দলের খেলোয়াড়দের মাঠে অস্থির বিচরণের পর মেসি-মেডেল দুইজনকেই মাঠ ছাড়তে হয়।

করিন্থিয়াস অ্যারেনায় আসলে ফুটবলটা হয়েছে এর আগ পর্যন্তই। আগের দুইবারের ফাইনালিস্ট, দুইবারই চিলি জিতেছিলেন শিরোপা। এসব তো ছিলই, আর গত বিশ্বকাপে চিলি বাদ পড়ার দুই দেশের ফুটবলীয় সম্পর্কেও কিছুটা টান পড়েছিল। তাই তৃতীয় স্থান নির্ধারনী হলেও এই ম্যাচ নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিল না খুব একটা। সেটা ম্যাচের শুরুতেও বুঝা যাচ্ছিল। দুই দলের খেলোয়াড়েরাই টুকটাক ফাউল করে প্রতিপক্ষের গতি নষ্ট করছিল। আর্জেন্টিনা এদিন একাদশে পরিবর্তন এনেছিল দুইটি। জিওভানি লো সেলসো ও পাউলো দিবালা ফিরেছিলেন লাউতারো মার্টিনেজের জায়গায়। শুরু থেকেই চিলির বিপক্ষে ধারালো ছিল আর্জেন্টিনার আক্রমণ। এগিয়ে যেতে লা আলবিসেলেস্তেরা সময় নিয়েছে মাত্র ১২ মিনিট।

গোলের উৎস ছিলেন মেসিই। আর্জেন্টিনার অর্ধে মিডফিল্ড লাইনের ঠিক পেছনে পাওয়া ফ্রি কিকটা নিজেই আদায় করে নিয়েছিলেন দারুণ এক ড্রিবলের পর। চিলির খেলোয়াড়রা প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুইক ফ্রি কিক থেকে বুদ্ধিদীপ্ত এক থ্রু পাস মেসি বাড়িয়েছিলেন সার্জিও আগুয়েরোর উদ্দেশ্যে। তিনি প্রস্তুতই ছিলেন, বল পেয়ে সোজা চলে গেছেন ডিবক্সের ভেতরে। দুই ডিফেন্ডার ফ্রি কিকের সময় দৌড় শুরু না করায় আগুয়েরোর সামনে ছিলেন শুধু গোলরক্ষক আরিয়াস। এগিয়ে এসেও পার পাননি তিনি, আগুয়েরো কোণাকুণি ফিনিশে গোল করে আর্জেন্টিনাকে ভালো সূচনা এনে দেন।

চিলি অবশ্য এরপর আরও চাপে পড়ে যায় অ্যালেক্সিস সানচেজকে হারিয়ে। ইনজুরি নিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। তখন চিলিকে আরও চেপে ধরে আর্জেন্টিনা। দিবালা মাত্র পঞ্চমবারের মতো মেসির সঙ্গে একাদশে নেমেছিলেন, তিনি জানিয়ে রাখলেন মেসির সঙ্গে এক দলে খেলার সামর্থ্যের কথা। মিডফিল্ড থেকে জিওভানি লো সেলসো পাস দিয়েছিলেন, দিবালার পেছনে ছিলেন দুই ডিফেন্ডার। দারুণ এক টার্ন নিয়ে দুইজনকে বোকা বানিয়ে দিবালা এগিয়ে যান ডিবক্সের দিকে। ভেতরে ঢুকে, আরও একবার এগিয়ে আসা আরিয়াসের পাশ দিয়ে চিপে করা দুর্দান্ত এক গোলে চিলিকে আরও পিছিয়ে দেন দিবালা।

এরপর দুই দলের খেলোয়াড়রা এক চোট বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে একটি ফাউল কেন্দ্র করে। আর্তুরো ভিদাল তখন দিবালার মুখে হাত দিলেও রেফারির চোখ এড়িয়ে যায় সে ঘটনা। তবে উত্তাপের শুরু তখন থেকেই।

ম্যাচের আধঘন্টা পেরুনোর পর লিড আরও বাড়িয়ে নিতে পার আর্জেন্টিনা। দারুণ এক আক্রমণ থেকে দিবালার ভলি সে সময় চলে যায় বাইরে দিয়ে। প্রথমার্ধ শেষে অবশ্য এসব কিছুই মিলিয়ে গিয়েছিল লাল কার্ডের ঘটনায়। দ্বিতীয়ার্ধে দুইদল যখন মাঠে নামল তখন ফুটবলের চেয়ে বরং আবেগ আর যুদ্ধটাই বেশি দেখল সাও পাওলো। এর মাঝেও ৫৪ মিনিটে আর্জেন্টাইনদের সুবর্ণ এক সুযোগ নষ্ট করে দেন পুলগার। কাউন্টার অ্যাটাক থেকে আগুয়েরো ক্রস করেছিলেন গোলের সামনে থাকা দিবালাকে। কিন্তু বল দিবালার পর্যন্ত পৌঁছানোর ঠিক আগের মুহুর্তে দারুণ এক ক্লিয়ারেন্স করে চিলিকে ম্যাচে টিকিয়ে রাখেন পুলগার।

মিনিট তিনেক পর লো সেলসো ডিবক্সের ঠিক লাইন বরাবর জায়গায় চার্লস আরাঙ্গিজকে ফাউল করে বসলে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন রেফারি। এ দফায় অবশ্য ভিএআরের সাহায্য নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছেন তিনি। আর্তুরো ভিদাল স্পটকিক থেকে গোল করে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন চিলিকে। এরপর অবশ্য বাকি সময়ে তেমন একটা সুযোগ তৈরি করতে পারেনি সানচেজ বিহীন চিলি। বরং বদলি ডি মারিয়াই ঘুরিয়ে দিতে পারতেন খেলার মোড়। মিডফিল্ড থেকে কয়েকজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ডিবক্সের ভেতর ফাঁকায় থাকা আগুয়েরোকে পাস দিয়েছিলেন তিনি। আগুয়েরো আরিয়াসের মাথার ওপর দিয়ে করেছিলেন চিপ। কিন্তু সে দফায় এগিয়ে এসে নিজের শরীর বড় করে ফেলা কাজে দিয়েছে আরিয়াসের। তার মাথায় লেগে আর নিশ্চিত গোল পাওয়া হয়নি আগুয়েরোর।

শেষদিকে অবশ্য আর্জেন্টিনা খেলেছে পুরোপুরি রক্ষণাত্মক। দুই দলের খেলা দেখে মনে হতে পারে কোনো শিরোপার জন্য লড়ছে তারা। একদল আক্রমণে, অন্যদল প্রাণপনে ডিফেন্ড করে যাচ্ছে। সেটা শেষ পর্যন্ত কাজেই এসেছে আর্জেন্টিনার। স্কালোনির দল যুদ্ধংদেহী ম্যাচে শেষ পর্যন্ত একটা জয় পেয়েছে। দল তৃতীয় হলেও অবশ্য সেই মেডেল নেননি মেসি। তার সতীর্থরা মাঠে মেডেল গ্রহণ করলেও সেটা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক।

এ বিভাগের অন্যান্য