সময় এসেছে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার

৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে যদি আজকের নারীর অবস্থান চিন্তা করি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে নারীর জীবনমান আসলেই কতটুকু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সে বিষয়ে এক ধরণের দ্বিধায় আক্রান্ত হই।

কর্মজীবী নারী হিসেবেই জানি পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা মোটেও সহজ সাধ্য নয়। হাশরের ময়দানের পুলসিরাতের পুলের মতোই সূক্ষ্মতি সূক্ষ্ম বিষয়গুলো মাথায় রেখে এগোতে হয় প্রতিটি মুহূর্তে। একটু এদিক সেদিক হলেই শেষ, নীচের গণগণে আগুনে পরে জ্যান্ত দগ্ধ হতে হবে নিশ্চিত।

আপাত দৃষ্টিতে কর্মজীবনে সফল নারীরা সহকর্মী পুরুষদের চোখে শ্রদ্ধা-সম্মান পেলেও আড়ালে আবডালে অনেককে এই বলে ভর্ৎসনা করতে শোনা যায়, ‘এই মহিলা ঠিক নারীদের মতো নয়, খানিকটা পুরুষালী, রুক্ষ, শুষ্ক ইত্যাদি ইত্যাদি।’ মহিলা যদি রূপবতী হয় আর উপরোক্ত একটি শব্দও তার সাথে ম্যাচ না করে তখন পুরুষ নিজের ইগোকে সেটিসফাইড করার জন্য মিথ্যা ফন্দি আঁটে, নির্লজ্জ অসভ্যতায় নিজেকে ছোট করে হলেও প্রতিযোগিতায় পরাজিত পুরুষ তখন নারীর চরিত্রে কলঙ্ক দিয়ে তৃপ্ত হবার চেষ্টা করে। মহিলাকে অন্যের চোখে খাটো করার প্রাণান্তকর চেষ্টার যেন কমতি নেই।

কেবল পুরুষ নয় জীবনে অসফল নারীটিও যেন ওত পেতে থাকে একজন সফল নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, ‘ওই নারী তো সংসারী নয়, বাইরে বাইরে থাকে একজন ভালো মা, ভালো স্ত্রী হয় কি করে?’

কর্মক্ষেত্রে সফল নারীরাও যে একজন ভালো মা এবং স্ত্রী হয়ে পারিবারিক ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারে তা অনেকেই মানতে নারাজ। নারীকে অবদমনের চেষ্টায় পুরুষরা নারীকে সুশ্রী, কোমল, অবলা দেখতে যতোটা পছন্দ করে বুদ্ধিমতী বাকপটু নারী তাদের ঠিক ততোটাই অপছন্দের।

সহস্রাব্দ ধরে অভ্যস্ততারও একটি ব্যাপার আছে, নারী মানেই যেন লতার মতো পরগাছা, অন্যের উপর নির্ভরশীল তাকে হতেই হবে। কখনো বাবা, কখনো ভাই, কখনো স্বামী নতুবা ছেলে। অবিবাহিত, ডিভোর্সি কিংবা বিধবা অর্থাৎ একা নারীকে এই সমাজ এক ধরণের বোঝা বলে মনে করে, মেনে নিতে কষ্ট হয় কিংবা ভয় পায় । শুনতে খারাপ শুনালেও সত্য, সেই নারী যদি স্বয়ং সম্পূর্ণ হয় তাহলে আর কথাই নেই, নারী-পুরুষ সবাই মিলে তার পেছনের পুরুষটিকে খোঁজার বৃথা চেষ্টায় ব্যাপৃত হয় । পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আনমনে হলেও ‘স্বয়ং সম্পূর্ণ’ একা নারীর প্রতি এক ধরণের জিঘাংসা কাজ করে।

ধর্মান্ধতা নারী প্রগতির অগ্রযাত্রায় আরেকটি বাঁধা স্বরূপ। আমাদের ধর্মে হযরত মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর স্ত্রী বিবি খাদিজা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, কন্যা ফাতেমা এবং তার সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী বিবি আয়সা (রাঃ) এর অবদানের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মান্ধাতার আমলের ধর্মান্ধ মৌলোভি তথা ধর্মগুরুরা গ্রামে গঞ্জে নারীর শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নারী প্রগতির ধারাকে রুদ্ধ করেন। নারীরা শিক্ষিত হলে সমাজ সচেতন হওয়ার পাশাপাশি নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হবেন ঠিক এই জায়গাটিতেই তাদের আপত্তি। কারণ তারা ক্রমাগত ওয়াজ করেন নারীকে প্রহার করার ক্ষমতা তার নিজস্ব পুরুষটির রয়ে গেছে, যদিও কোরআনের কোথাও এর সত্যতা মিলেনি। প্রভু হয়ে নারীকে পদানত করার হীন চেষ্টা কেবলই।

যতদিন না সার্বিকভাবে নারীর শিক্ষা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে না। নারী প্রগতি কিংবা নারী স্বাধীনতার মূল বিষয় হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ততা বা সক্ষমতা এবং অধিকার, তা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কিংবা নিজের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এর জন্য যত বাঁধাই আসুক, পথ যত কণ্টকাকীর্ণই হোক তা প্রতিহত করে এগিয়ে যেতে হবে নারীকেই।

একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে পৃথিবী ব্যাপী অর্ধেক নারী, সেই নারীকে অবজ্ঞা করে কোনো উন্নয়ন ধারা রচিত হওয়া সম্ভব নয়। নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে সবার প্রথমে প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

নারী মানেই উর্বশী, সুশ্রী, ছলনাময়ী এই কথাগুলো কেবল দুর্বল চিত্তের নারীদের জন্যই প্রযোজ্য, যেখানে নারীর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এবং জানান দিতে ছলনা কিংবা সুন্দর মুখশ্রীকে আশ্রয় করতে হয়। জীবনের কিছু নিয়ম আছে, দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় সেখান থেকে ধাক্কা না দিয়ে আর উপায় থাকে না, ‘যেখানেই বাঁধা সেখানেই ধাক্কা’। সময় এসেছে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার।

লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য