নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি হাওরের বাঁধের কাজ, শঙ্কায় কৃষক
সুনামগঞ্জের ধর্মাপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওরের ডুবাইল এলাকার বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্ধ দেওয়া হয় ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ১২টাকা। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই বাঁধের কাজ শেষণ হওয়ার কথা। অথচ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। নির্ধারিত সময়েই মধ্যে কাজ শেষ করতে এই বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিকে একাধিকবার তাগিদ দেয় উপজেলা প্রশাসন। তবে এতে কোনো ফায়দা মিলেনি।
কেবল এই একটি বাঁধ নয়। পুরো জেলায়ই একই চিত্র। নির্ধারিত সময় ফুরলেও শেষ হয়নি বাঁধের কাজ। এদিকে, ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। মার্চের শুরুও দিকে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে করে হাওরের বোরো ফসল নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে আরও কিছুদিন সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পাউবো কর্মকর্তারা। তবে জেলা প্রশাসন ও কৃষকদের অধিকার আদায়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের দাবি, এ পর্যন্ত ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের হিসেব মতে, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরো জেলায় প্রায় ৮১ শতাংশ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৯টি প্রকল্প রয়েছে। এ উপজেলায় শেষ হয়েছে ৭৬ শতাংশ কাজ। জামালগঞ্জ উপজেলায় ৫২ টি প্রকল্পের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৮৩ শতাংশ। তাহিরপুরে ৬৬ টি প্রকল্পের ৮০ শতাংশ। ধর্মপাশায় ৮৭টি প্রকল্পে ৮২ শতাংশ, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ১৬টি প্রকল্পে ৮৭ শতাংশ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ৪০টি প্রকল্পের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৭২ শতাংশ, শাল্লায় ১১৪টি প্রকল্পে ৭৮ শতাংশ, দিরাইয়ে ১০১টি প্রকল্পে ৮২ শতাংশ, জগন্নাথপুরে ৫০টি প্রকল্পে ৮২ শতাংশ, দোয়রাবাজারে ২৩ টি প্রকল্পে ৮৩ শতাংশ এবং ছাতক উপজেলায় সাতটি প্রকল্পে ৮৪ শতাংশ।
হাওরের কৃষকদের নিয়ে কাজ করা পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা’র সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অগ্রতির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার কোন মিল নেই।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের ৩৭ টি হাওরের ৭০ ভাগ বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু কম্পেকশন ও ঘাস লাগানোসহ অন্যান্য কাজ বাকি রয়ে গেছে। কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ শেষ না হওয়ায় ২৭ টি হাওড়ের বোরো ফসল আগাম বন্যার হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ঠিক উচ্চতা ও প্রস্ত না থাকা, ঘাস না লাগানো, অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ, উচ্চতা অনুযায়ী স্লোপ না হওয়ার অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, গণশুনানি না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করায় অনেক অযোগ্য লোক পিআইসির সদস্য ও সভাপতি হয়েছেন। ফলে সময়মতো কাজ শেষ হয়নি।
২০১৭ সালে অকাল বন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় বিস্তৃর্ণ বোরো ফসল। সরকারী হিসেবে, ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিলো প্রায় দ্বিগুণ। সে বছর ফসলহানির পর পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
চলতি অর্থ বছরে ৫৫৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)-এর মাধ্যমে জেলার ছোটবড়ো ৩৭টি হাওরে ৪৫০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৯৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে সুনামগঞ্জ সদরে ৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার, বিশ্বম্ভরপুরে ১৫ দশমিক ২৩ কিলোমিটার, তাহিরপুরে ৫৫ দশমিক.৪৩ কিলোমিটার, ধর্মপাশায় ৫৫ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার, জামালগঞ্জে ৬১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ৩৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার, জগন্নাথপুরে ৩১ দশমিক ৮২ কিলোমিটার, ছাতকে ৪ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার, দোয়ারাবাজারে ১০ দশমিক ২২ কিলোমিটার, দিরাইয়ে ৭৪ দশমিক ২৬ কিলোমিটার, শাল্লায় ৯৯ কিলোমিটারসহ বাঁধ নির্মাণ করার কথা।
বাঁধের কাজ প্রসঙ্গে জগন্নাথপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজুল আলম বলেন, জগন্নাথপুর উপজেলায় এখন পর্যন্ত ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে ১৫ দিন সময় বাড়ানোর দাবি করছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, এবার বাঁধের কাজ দেরীতে শুরু হয়েছে। তাই নির্ধারিত সময়ে কাজ মেষ করা যায়নি। মাত্র দেড়মাসে যে পরিমান কাজ শেষ হয়েছে তা অবিশ্বাস্য। আশাকরি বাকী কাজ দ্রুত সময়েই মধ্যেই শেষ হবে।
এদিকে, নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ শহরে মানববন্ধন করেছে ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ নামের একটি সংগঠন।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও হাওড় বাঁধ নির্মান তদারকিতে গঠিন জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, সার্বিকভাবে বাঁধের কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আমরা দিন-রাত মাঠে আছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।
এদিকে, গত সপ্তাহে টানা দুইদিন বৃষ্টিহয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী আজ ৫ মার্চ থেকে আবার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
আবাহওয়া অধিদপ্তর সিলেটের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, ৫ মার্চ থেকে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়া ফলে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আবার ৮ মার্চ থেকে সিলেটে অস্থায়ী দমকা হাওয়া ও ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি ও ভারি বর্ষণ ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৬১৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে।