নির্বাচনে শান্ত শহর, অশান্ত গ্রাম
নির্বাচনে রাজশাহীর ছয়টি আসনের মধ্যে চারটিতেই কেন্দ্র দখলের চেষ্টা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এতে অশান্ত রয়েছে সাতটি উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম। তবে পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে গ্রামগুলো অশান্ত হয়ে উঠলেও শান্ত রয়েছে পদ্মাপাড়ের এই শহর।
রোববার ভোটগ্রহণ শুরুর পর রাজশাহীর দুটি উপজেলায় সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন উপজেলায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫০ জন। তাদের মধ্যে ২২ জনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এমন উত্তপ্ত পরিবেশে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আবু হেনা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
দুপুরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এই ঘোষণা দেন। নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়ে আবু হেনা অভিযোগ করেন, তার এলাকায় কেন্দ্র দখল করে জালভোটের উৎসব চলছে। নৌকার প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের সমর্থকরা ধানের শীষের সমর্থকদের কেন্দ্রে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সাধারণ ভোটারদেরও জান-মালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। হানাহানি বন্ধে তিনি নির্বাচন বর্জন করছেন।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী-৩ আসনের মোহনপুর উপজেলায় কেন্দ্র দখল নিয়ে ধানের শীষের প্রার্থী শফিকুল হক মিলনের সমর্থকরা আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করেন। নিহত ব্যক্তির নাম মেরাজুল ইসলাম (৩০)। জাহানাবাদ ইউনিয়নের পাকুড়িয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। এর ঘণ্টাখানেক পর রাজশাহী-১ আসনের তানোর উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা আওয়ামী লীগের আরেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করেন। তার নাম মোদাচ্ছের আলী (৪০)। দুপুর একটার দিকে তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মোদাচ্ছের আলী মোহাম্মদপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। তিনি পাঁচন্দর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোরশেদ আলী মৃধা জানান, ঘটনার পর কিছু সময়ের জন্য ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র আবদুর রাজ্জাক খান জানান, মোদাচ্ছের আলী ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই সময় হঠাৎ করেই জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠি ও হকিস্টিক নিয়ে হামলা চালান। হামলাকারীরা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ভোটারদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্থাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা মোহনপুর উপজেলার পাকুড়িয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করতে গেলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় তারা মেরাজুল ইসলামকে পেটালে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে পুলিশ গিয়ে দুপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। সেখানে কিছু সময় বন্ধ থাকার পর পুনরায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে সকালে ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। কিন্তু বেলা ১১টার পর বিভিন্ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ শুরু হলে ভোটারের উপস্থিতিও কমতে থাকে। রাজশাহী-১ আসনের গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাট উচ্চ বিদ্যালয়, বিদিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হরিশংকরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ধানের শীষের প্রার্থী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের সমর্থকদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন নৌকার প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরীর সমর্থকরা।
দুপুরের পর নৌকার সমর্থকরা কেন্দ্রগুলো দখলে নিয়ে নেন। এসব কেন্দ্রের প্রতিটিতেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আহত হন অন্তত ১০ জন। এ আসনের তানোর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে বেলা ১১টা থেকেই লাঠিসোটা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন নৌকা প্রতীকের সমর্থকেরা। ধানের শীষ প্রতীকের সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইলে তাদের বাধা দেয়া হয়। পরে সেখানে দুই দলের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলি ছোঁড়ে পুলিশ।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহী-৫ আসনের দুর্গাপুর উপজেলায় বখতিয়ারপুর গ্রামে ভোট দিতে যাওয়ার সময় হামলায় একই পরিবারের ছয়জন আহত হন। বেলা ১২টার দিকে দুর্গাপুর পৌর এলাকার রইপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র দখলে নিতে একদল লোক হামলা চালালে ফারুক আহমেদ নামে এক পুলিশ সদস্যের মাথা ফেটে যায়। এর আগে সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী-৩ আসনের পবা উপজেলার নওহাটা পূর্বপাড়া পুঠিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে ককটেল হামলার শিকার হন হাবিব মিয়া (৪৫) নামে এক ভোটার। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনেই নৌকার প্রার্থী আয়েন উদ্দিনের সমর্থকদের নওহাটা এলাকায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়।
দুপুর ১২টার দিকে পবা উপজেলার মুরারিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ২৫০টি ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। উত্তেজনার কারণে দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। এ সময় কেন্দ্র থেকে প্রায় ২০০ ভোটারকে ভোট না দিয়েই ফিরে যেতে দেখা যায়। তাদের একজন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভোট দেয়ারও অধিকার নাই। বাড়ি চলে যাচ্ছি।’
জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে বিএনপির প্রার্থী নেই। ভোট গ্রহণকালে এই দুই উপজেলায় কোনো সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবে রাজশাহী-১ আসনের গোদাগাড়ী-তানোর, রাজশাহী-৩ আসনের পবা-মোহনপুর, রাজশাহী-৪ আসনের বাগমারা ও রাজশাহী-৫ আসনের পুঠিয়া-দুর্গাপুর উপজেলায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে নানা বিশৃঙ্খলা ঘটেছে। এতে এই সাত উপজেলা উত্তপ্ত রয়েছে। তবে রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বিচ্ছিন্ন দুএকটি ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। যেসব কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে তার প্রতিটিতেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ করতে দেখা গেছে। সদর আসনে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। আর ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু।
সকালে নগরীর জুলফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভোট দেন ফজলে হোসেন বাদশা। এই কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নগরীর উপশহর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দেন সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, সাবেক মেয়র ও নগর বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার। কেন্দ্রটিতে গিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ করতে দেখা গেছে। বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুর কেন্দ্র রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ হয়েছে।
দুপুরে নারীদের কেন্দ্র রাজশাহী সদরের নওদাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভোটাররা যে যার মতো করে ভোট দিচ্ছেন। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার রাসেল আলী জানান, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বের হয়ে আশফিয়া নাজনিন বলেন, ‘কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভালোভাবে ভোট দিতে পেরেছি।’
তবে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর অন্নদাসুন্দরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুর্বৃত্তদের হামলায় পাঁচ-ছয়জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাইরে বিএনপি কর্মীরা ভোটারদের স্লিপ দিচ্ছিলেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাদের কয়েকজনের মাথায় চেয়ার দিয়ে আঘাত করে। এতে পাঁচ-ছয়জন আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় বেলাল উদ্দিন ও মাসওয়ার আলী নামে দুই বিএনপি কর্মীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির দপ্তর সম্পাদক নাজমুল হক ডিকেন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, ‘বিকেল ৩টার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় নৌকার সমর্থকরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে ত্রাস সৃষ্টি করেন। এরপর ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের বের করে তারা কেন্দ্র দখলে নেন। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। চলেছে জাল ভোটের মহোৎসব।’
তবে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রাজশাহীতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটবেই। তবে নির্বাচন অত্যন্ত সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিতও করা হয়নি।