এবার ভোটের মাঠে মাশরাফি
মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে আরও একটি সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। নিশ্চয়ই উৎসবে মাতবেন ক্রিকেটাররা। উৎসবে মাতবেন অধিনায়ক নিজেও। প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনটা শেষ করেই হয়তো সতীর্থদের নিয়ে শুরু করেছেন সে উৎসব। কিন্তু কাল থেকে মাশরাফিকে যে পুরোপুরি অন্য একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। সে ব্যস্ততা ক্রিকেটের চেয়েও অনেক কঠিন। কাল থেকে বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক হয়ে উঠবেন পুরোপুরি অন্য এক মানুষ—পুরোদস্তুর এক রাজনীতিক।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাশরাফি সে মহাযজ্ঞের অংশ। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। নড়াইল-২ আসন থেকে তিনি লড়বেন জাতীয় সংসদে যাওয়ার জন্য— ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। সে লড়াইটা তাঁকে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করাবে, সত্যিকার অর্থেই ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে এমন কিছুর মুখোমুখি তাঁকে কখনোই হতে হয়নি।
সমালোচনার তীব্র হলকা তাঁর দিকে ছুটে আসবে। তাঁকে সেটি সামলাতে হবে। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা মেনে নিতে হবে, যেমনটি আগে কখনোই হয়নি। মাশরাফি কেমন করবেন তাঁর এ নতুন জীবনে, এ নতুন ভূমিকায় সে প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
মাশরাফি অবশ্য নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বেশ কিছু দিন ধরেই। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে কেমন যেন একটা বিদায়ের রাগিণী তিনি শুনতে পাচ্ছেন। এটাই কী শেষ? সবারই গলা ধরে যাচ্ছে প্রশ্নটা করতে। মাশরাফিকে ক্রিকেট মাঠ থেকে বিদায় করে দেওয়াটা কী এতটাই সহজ? দেশের মাটিতে কী আমরা আর কখনোই তাঁকে জাতীয় দলের জার্সিতে দেখব না?
মাশরাফি অবশ্য উত্তরটা দিয়েছেন একটু অন্যভাবে। শেষও হতে পারে, আবার না–ও হতে পারে। পুরোপুরি রাজনীতিবিদের মতোই উত্তর। রাজনীতিতে যে শেষ কথা বলে কিছুই নেই। কিন্তু এটা তো সত্যি, শতভাগ ক্রিকেটার, ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর জীবনের অধ্যায়টিকে বিদায় তাঁকে বলতেই হচ্ছে। এটা সবাই যেমন জানেন, মাশরাফি নিজেও খুব ভালো করেই জানেন।
আচ্ছা, কাল থেকে কেমন হবে তাঁর নতুন জীবন। সে জীবনের রুটিনটাই-বা কেমন হবে? কালই হয়তো নড়াইলে চলে যেতে হবে। নিজের জন্মস্থান, বেড়ে ওঠার জায়গায় এবার গেলেও বাড়ির শান্ত পরিবেশে তাঁর থাকা হবে না। মায়ের আঁচল ঘেঁষে বসে ছুটির আমেজে দিন কাটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি এবারের সফরে বড্ড মিস করবেন। স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ের সান্নিধ্যও তিনি বড় মিস করবেন। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে তাঁর দিনরাত্রি কাটবে মিছিল, পথসভায়, নিজের নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে জনসংযোগে। মাশরাফির তখন বড্ড ইচ্ছে করবে বাড়িতে ছুটে যেতে, কিংবা নিজের চিরচেনা জায়গায় ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ আড্ডায় বসতে, কিংবা চিত্রা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরতে। তাঁকে চিত্রা নদী পাড়ি দিতে হবে ঠিকই, কিন্তু সেটি হবে রাজনীতিকের বেশে, কর্মী-সমর্থকে পরিবেষ্টিত হয়ে। প্রিয় বাইকে হয়তো চড়বেন ঠিকই। কিন্তু তাঁকে বসতে হবে কোনো কর্মীর বাইকে। এমন একটি জীবনের প্রস্তুতি মাশরাফি হয়তো ঠিকই নিয়ে ফেলেছেন।
মাশরাফির নতুন অভিজ্ঞতাটা যে হবে বিরোধিতা, সেটি আগেই বলা হয়েছে। তিনি যেদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিলেন, সেদিনই নড়াইলের বিএনপির এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব বলেছিলেন, ‘আমাদের জেলার সন্তান হিসেবে মাশরাফিকে আমরা ভালোবাসি। সে ভালোবাসা আমাদের অটুট থাকবে। তাঁকে নিয়ে আমরা গর্বিত। ক্রিকেট মাঠে আমরা তাঁর সাফল্য সব সময়ই চাই। কিন্তু যেহেতু তিনি নৌকার মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন, এখন থেকে তিনি আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করব ভোটের রাজনীতিতে তাঁকে হারিয়ে দিতে।’
নিজ জন্মস্থান তো বটেই, ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির প্রতি এক ধরনের নিরঙ্কুশ ভালোবাসা কাজ করত গোটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই। শত ব্যর্থতাতেও ‘আমাদের একজন মাশরাফি আছে’ বলে সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার একটা প্রবণতা থাকত সবার মধ্যে। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সে ব্যাপারটির অবসান ঘটতে যাচ্ছে। তিনি এখন একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের। যে দলের বিরোধী মতের সংখ্যা যথেষ্টই। আগামী ১৫ দিন মাশরাফি এই ব্যাপারটা কীভাবে সামলান, সেটি দেখার অপেক্ষায় গোটা দেশ।
খেলার মাঠ থেকে এবার ভোটের মাঠ। লড়াকু মাশরাফি নেমে পড়লেন আরও কঠিন লড়াইয়ে। আজকের পরেই। কাল থেকেই।