নতুন প্রজন্মের সঠিক বিকাশের লক্ষ্যে

শুধু খেলার মাঠে খেলতে গেলেই কি সঠিক বিকাশ হয়? নির্মল বিনোদনের মাধ্যম ও মানসিক বিকাশের উপায় হিসেবে কিছু খেলাধুলা তো ঘরে বসেও করা যেতে পারে। স্কুলপড়ুয়াদের হাতে গেম খেলার জন্য স্মার্টফোন তুলে না দিয়ে ড্রইং রুমে বসে তাকে নিয়ে সাপলুডু কিংবা বাড়ির ছাদে এক্কাদোক্কাও খেলা যায়। সন্তানের জন্য ‘কোয়ালিটি টাইম’ খুব জরুরি। আর এর অভাব দেখা দিলে নতুন প্রজন্মের সঠিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। ‘প্রজন্ম’-এর এবারের আয়োজনে প্রচলিত খেলার ধরন বনাম ভিডিও গেমস প্রসঙ্গে লিখেছেন এ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। এটি সম্পাদনা করেছেন রিয়াদ খন্দকার ও গ্রন্থনা করেছেন সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার

‘সন্তানের নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বাবা-মায়ের’

—ডা. মেখলা সরকার

সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

দুটি কারণে খেলাধুলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আউটডোর গেম বা সাধারণত মাঠে ক্রিকেট-ফুটবল খেলতে গেলে শারীরিক বিকাশ হয়, শরীরে রোদে লেগে ভিটামিন-ডি তৈরি হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, খেলাধুলার মাধ্যমে মানসিক বিকাশ ঘটে, যা একই সঙ্গে মনকে সতেজও রাখে। মাঠে অনেকের একসঙ্গে খেলাধুলা করার ফলে নেতৃত্বগুণ তৈরি হয়। এমনকি খেলায় হারলে হার মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়, যা পরবর্তী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এ ধরনের খেলাধুলা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। শুধু মাঠের খেলাধুলাই নয়, পরিবারের সবাই মিলে যখন লুডু খেলে বা খেলাচ্ছলে আড্ডা দেয়, তখন তাদের মধ্যে আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়। এসবই জীবনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। এই প্রজন্মের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এ ধরনের খেলাধুলা করার অভ্যাসটাই হারিয়ে গেছে। তারা সকালে ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, বিকেলে বাসায় ফেরার পর কম্পিউটার বা স্মার্টফোন হাতে নিয়ে গেম খেলতে বসে যাচ্ছে। খেলাধুলায় যে শরীরচর্চার ব্যাপার ছিল, কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের খেলায় তা নেই। দীর্ঘক্ষণ একজায়গায় বসে খেলার কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্থূলতা দেখা দিচ্ছে, চোখের ওপর চাপ পড়ছে, এমনকি অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। অনলাইনে কিছু কিছু গেমে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা মেসেজ পাঠানোর সুযোগ থাকলেও বাস্তবজীবনের সামাজিকতার শিক্ষা তাতে থাকে না। এসব ডিজিটাল গেম খেলতে খেলতে হয়তো অনেক তথ্য জানা যায় বা শেখা যায়, কিন্তু এটা বাস্তবে কোনোকিছু শেখার মতো কম্প্রিহেনসিভ লার্নিংয়ের স্বাদ দিতে পারে না। কম্পিউটার গেমে বিনোদন আছে, কিন্তু মাঠের খেলা বা লুডু খেলার নির্মল বিনোদন এখানে অনুপস্থিত। অনেক অভিভাবক বলেন, এলাকায় বা শহরে মাঠ নেই, ছেলেমেয়ে কোথায় খেলতে যাবে। তাদেরকে বুঝতে হবে, খেলার মাঠই শিশুদের বিকাশের একমাত্র স্থান নয়। কর্মব্যস্ততা থাকলেও ঘরে ফিরে সন্তানকে সময় দেওয়াটা তাদের দায়িত্ব। তা না করে তারা নিজেরাও যদি ঘরে ফেরার পর স্মার্টফোনে সময় ব্যয় করেন, তবে সন্তান বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। ঘরে লুডু খেলুন, গল্প করুন। বাড়ির ছাদেও কিছু খেলাধুলা করতে পারেন। এখন থেকেই এ ব্যাপারে সচেতন না হলে পরবর্তীতে সন্তান বেড়ে ওঠার পর সে যখন নানা সমস্যার সম্মুখীন হবে, তখন তার দায় এড়াতে পারবেন না।

‘প্রযুক্তি যেন বিশাল এ পৃথিবীকে ছোট পর্দায় বন্দি করে ফেলেছে’

—তাজরীন ইসলাম তন্বী

শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শৈশবে মফস্বলে বেড়ে ওঠার কারণে মাঠঘাট, পুকুর দাপিয়ে বেড়ানো, গাছে ওঠা, মাছ ধরা, গোল্লাছুট, বৌচি, মাংসচোর, কুতকুত, কুমিরডাঙা, এলন্ডি লন্ডন, ক্রিকেট সবই খেলেছি ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে। এভাবেই শিখেছি খেলতে গিয়ে ব্যথা পেলে কাঁদতে হয় না। আরও শিখেছি দল বেঁধে একটা সমস্যার সমাধান কীভাবে করতে হয়, কীভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। ফলে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা পরিবেশে বড় হয়েছি। নিজেদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত মেলে দৌড় দিয়েই হয়তো নিজের ভিতরের সব পরাধীনতা, সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, হীনম্মন্যতার বৃত্ত ভেঙে চুরমার হয়েছে। বিদ্যুত্ চলে গেলে একসঙ্গে অন্ধকারে তারা আর জোনাকি গুনতে গুনতেই স্বপ্ন দেখেছি। সামাজিকতার শিক্ষা পেতে কখনো আলাদা কিছু করতে হয়নি। সারাদিন খেলাধুলা করে দিনশেষে ঘরে ফিরে মায়ের মার খেয়েও সুস্থতার কোনো কমতি ছিল না। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়েই একটা দল হয়ে ওঠা, বন্ধুদের যত্ন নেওয়া, ভালোবাসতে শেখা। হয়তো এ কারণেই ছোট্টবেলার খেলার সাথিরা আজও আত্মার অংশ হয়ে আছে। আজকাল গ্রামে গিয়ে দেখি স্কুলের খেলার মাঠটা ভরা বিকেলে কেমন ফাঁকা পড়ে আছে। বড় বড় ঘাসের মধ্যে মাঠের এক কোণায় গোল হয়ে বসে কয়েকজন স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে। অথচ এই মাঠেই একসময় খেলার জায়গা পাওয়া যেত না। বই পড়ুয়ারা সংখ্যায় কমছে আশঙ্কাজনক হারে। লুডুর বোর্ডে লুডু না খেলে এখন সবাই লুডোস্টার খেলে। কিন্তু একসঙ্গে ওরকম চিত্কার করার আনন্দ তো আর কারো পাওয়া হয় না।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতা হয়তো আমাদেরকে দ্রুত চিন্তা করতে শেখাচ্ছে। আমার ৫ বছর বয়সী ছোট ভাইবোন যে গতিতে গেম খেলে আমিও তা পারি না। এখন দুনিয়াটা অনেক বড়, চেনা মানুষের সংখ্যা বেশি, নেটওয়ার্ক নানা সুযোগ-সুবিধা অনেক সহজলভ্য করেছে। তবে আমার মতে, পাবজি, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্স ইত্যাদি গেমগুলোর সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো এই মারামারি-কাটাকাটির প্রবণতা আমাদের মধ্যে খেলার নামে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। খেলার এসব প্রতিযোগিতাবোধ হয়তো আমাদের গতিময় করছে, তবে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, সম্পর্কের গভীরতা বোধ কমিয়ে দিচ্ছে। বরং বিশাল একটা পৃথিবী থেকে টেনে এনে আমাদের জোর করে একটা পর্দার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

‘স্মার্টফোনের রঙিন খেলায় আমরা

হারাই পরিবারের প্রতি আবেগ’

—মোসাদ্দেক মীম

শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পরিবার ছিল আমাদের খামখেয়ালিপনার বসতভিটা। রোজ রোজ সকালে একসঙ্গে ফজরের আজান আর গির্জার সাইরেনের ধ্বনিতে ভোর দেখা হতো আমাদের। আমাদের শৈশবের সকালগুলো ছিল বকুলের ঘ্রাণের মতোই অমলিন। রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো স্মৃতি হলেও এখনো রঙিন। তখন পরিবারের সবাই মিলে যখন সমবেত কণ্ঠে পুরোনো বাংলা গান গাইতাম, সেই সুর যেন ছুঁয়ে যেত হূদয়ের সমস্ত অনুভূতি। বাড়ির পাশের ছোট্ট মাঠে ভেসে বেড়াত আমাদের ছেলেবেলা, বিকেল বেলাটা জুড়ে ছিল কানামাছি-গোল্লাছুট খেলা। ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে বাড়ির শ্যাওলা পড়া ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর এক অদ্ভুুত নেশায় আমরাও যেন উড়ে যেতাম নীল আকাশে। পড়ার বইয়ের পাশে লুকিয়ে থাকা হুমায়ূন বা সুনীলের লেখাগুলো কল্পনায় ভাসত। বছরের দুটো ঈদের নতুন জামার গন্ধ আর পূজার মেলার আয়োজন জীবনের শ্রেষ্ঠ উত্সব ছিল। মেঘে মেঘে বেলা বয়ে গেছে অনেক, এখন রোজ সকালের আলো জানালায় এসে আমাদের ঘুম ভাঙাতে পারে না, রাতের ঘুম কেড়ে নেয় স্মার্ট ফোনের নীল রং। ঘুম পাড়ানির গান কেড়ে নিয়েছে মস্ত বড় হেডফোন, জীবনকে রাঙাতে ফেসবুকের হোমপেজে ভেসে বেড়ায় অজানা-অচেনা অনেক মুখ, হয় বন্ধুত্ব। ঠিক নেবো নেবো বলে নেওয়া হয় না পাশের বাসার কারোর অসুস্থতার খবর। পাবজি বা ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্সের চিকেন ডিনারের আশায় এখন পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবারের আনন্দ আর টানে না। পুরোনো কানামাছি এখন রূপ নিয়েছে মোবাইল গেমসে। এখনো ঘটা করে উত্সব এলেও উত্সবগুলো রেস্টুরেন্টের চেক ইনেই রয়ে যায়। জীবনকে উপভোগের আশায় স্মার্টফোনের রঙিন খেলায় আমরা হারিয়ে ফেলি পরিবারের প্রতি আবেগ, অনুভূতি, মায়া। নাগরিক যান্ত্রিকতায় আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাগুলো জেঁকে বসে মস্তিষ্কজুড়ে। দিনশেষে একলা হয়ে যাই, দীর্ঘশ্বাস কুড়ে খায় আমাদের। ঝুম বৃষ্টির রাতে শান্তির ঘরবাড়ির নিচে থেকেও আমরা শান্তি খুঁজতে যাই অনলাইনে! প্রযুক্তি আমাদের আরও কাছে আনার কথা দিয়েছিল, অথচ আমরা কাছের মানুষদের দূরে সরিয়ে দিলাম। পরিবারের রূপকথার গল্পকে ফেলে দিয়ে আমরা মুখোশপরা সভ্যতার রঙিন আলোতে প্রাণ হাতড়ে বেড়াই। শৈশবগুলো বাড়ি নেই, দিনগুলো বেঁচে দিয়েছি নয়া নয়া স্মার্টফোনের কাছে।

‘খেলা হোক বন্ধুর হাতে হাত ছুঁয়ে

—শান্তা তাওহিদা

সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাড়ছে বিমূর্ত ছায়া যোগাযোগ, আবছা হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে সামনে বসে থাকা মানুষটির শেষ বিন্দু। নীল খামের চিঠি নিয়ে এখন আর দরজায় হাতলের টুংটাং শুনি না। বহুদিন হাঁটি না সবুজ ঘাসে বাবার হাতটা ধরে। বিকেলে আর মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে আর ডাকে না কেউ। হঠাত্ বৃষ্টি নামলে বাবার বকুনি উপেক্ষা করে গায়ে কাঁদামাটি মেখে দামাল ছেলেদের ফুটবল খেলার চিরায়ত শৈশব হারিয়ে গেছে কবে। হাতে ছুঁয়ে হাতের বরফ-পানির খেলার চলও আজ আর নেই। হারিয়ে গেছে মুড়ি মাখা খেতে খেতে সাপ-লুডু খেলার খুনসুটির দিন।…

তারুণ্যের যে মনকে কোনো দিন চার দেয়ালে বন্দি করে রাখা যায়নি, সেই মন কী করে বন্দি হয়েছে আজ চারকোনা এক মুঠোফোন বা কম্পিউটারের পর্দায়। খেলারা হারিয়ে যায়নি, শুধু খেলাগুলোর মূর্ত-বন্ধুরা হারিয়ে গেছে। রক্ত-মাংসের বন্ধুরা হেরে গেছে বিমূর্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বন্ধুদের কাছে। যার সঙ্গে খেলতে খেলতে জয়ী হলে আনন্দে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করা যায় না। ফাঁকিবাজি করে জিততে গিয়ে ধরা পড়ার খুনসুটি করা যায় না। মাড়ানো যায় না সবুজ ঘাস, দেখা যায় না অস্তমিত সূর্যের শেষ সোনা রোদ। জামায় কাদামাটি মাখিয়ে মায়ের কানমলা খেতে হয় না…। আমরা কি এভাবে ভেবেছি কোনোদিন নাকি আমাদের শিশুর কাছে সম্পর্কের টান, বন্ধুত্বের টানের চেয়ে আজ বড় বড় হয়ে গেল প্রযুক্তির টান?

শিশুর জীবনে খেলা হলো মানসিক, ভাষিক ও সামাজিক যোগাযোগ বিকাশের এক বিশাল মাধ্যম। শিশুদের ভাষিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশের পূর্ববর্তী স্তরে শিশুর সঙ্গে বাবা-মায়ের বা লালন-পালনকারীদের খেলা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুদের ভাষিক ও সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা রয়েছে, তাদের প্রাক-বাচনিক স্তরে তাদের সঙ্গে খেলার মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খেলার মাধ্যমে করা যায় এমন বহু গুরুত্বপূর্ণ থেরাপিও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা । খেলার মাধ্যমে শিশুর বস্তু সম্পর্কে ধারণা বাড়ে, অনুধাবন ক্ষমতা টেকসই হয়, শিশুর ভাষার প্রকাশগত দিকসহ শিশুর মানসিক শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। খেলতে খেলতে শিশু সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা, বুদ্ধিগত দক্ষতাও অর্জন করে। এ ছাড়া খেলার মাঠ শিশুর নিয়ানুবর্তিতা, সততা, প্রতিজ্ঞা, ভদ্রতা, নম্রতার মতো সদাচারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি খেলাধুলা শিশুর আবেগ অনুভূতির প্রকাশের মাধ্যমও।

তাই যত সহজে আমরা বলি খেলা হলো একটি উত্কৃষ্ট শারীরিক ব্যায়াম, ঠিক সেভাবে আজ থেকে ভাবতে শুরু করুন যে, খেলা হলো আমাদের সামাজিক জীবনের এক নীরব পাঠশালা। তাই কেবল চার কোনা পর্দায় ছায়া মানবের সঙ্গে আর খেলা নয়। খেলা হোক শেষ বিকেলের সোনা রোদ চোখে-মুখে মেখে বাবা-মা, দাদু-দিদা আর দুষ্ট ভাই-বোনের সঙ্গে বারান্দায় মাদুর পেতে। খেলা হোক মাঠে-ঘাটে, বনে-বাঁদরে বন্ধুর হাতে হাত ছুঁয়ে।

‘মাঠের ফুটবলের চেয়ে বেশি

ঝোঁক প্লে-স্টেশনের ফিফা গেমে’

—শাশ্বত সৌম্য

শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

শওকত সাহেব তার ৮ বছরের ছেলে শিহাবকে নিয়ে পাড়ার একটি মাঠে এসেছেন। ঢাকা শহরে দু টাকার বাদাম পাওয়া গেলেও আজকাল খেলার মাঠ পাওয়া বিরল। সিদ্ধার্থ একটা বল নিয়ে কিছুক্ষণ তার ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলার চেষ্টা করলেন। শিহাব দু’পা এদিক ওদিক করে কিছুক্ষণ দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠে বলে উঠল, ‘বাবা, চল বাসায় যাই। ফিফা খেলি আমরা। তখন দেখবে কতগুলো গোল দেবো তোমাকে!’ এ ঘটনাটা কাল্পনিক হলেও এখন এরকম ঘটনা হরহামেশা হচ্ছে। দুপুরবেলা শংকু, ফেলুদা, হিমু পড়ে বিকালবেলা মাঠে গিয়ে গা গরম করে খেলা একটা জেনারেশন হঠাত্ লক্ষ করছে তাদের পরবর্তী জেনারেশন ফুল-টাইম স্মার্টফোন এবং টিভি গেমিংয়ের প্রতি ঝুঁকে গেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় এটি নোমোফোবিয়া, যা একধরনের আসক্তি। তৈরি হচ্ছে স্মার্টফোন ছাড়া চলতে না পারার মতো অভ্যাস। একটা কথা ঠিক হয়তো পুরোনো জেনারেশন নতুন জেনারেশনের কিছু কাজকে সবসময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। কিন্তু এই স্মার্টফোন আসক্তির প্রতি সবার সচেতনতা না থাকার কারণে এটি এতটা বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, সারারাত জেগে চ্যাটিং, গেমিং বা নিদেনপক্ষে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনার অভ্যাস ও মস্তিষ্কে একটি অসামঞ্জস্য তৈরি করে, যেটি পরে অনেক ক্ষতি করতে পারে।

শুরুর ঘটনায় ফিরে যাই, শওকত সাহেব ছেলেকে নিয়ে বাসায় এলেন। শিহাব দৌড়ে গিয়ে তার প্লে-স্টেশন খুলে ফিফা খেলতে শুরু করল। শওকত সাহেব স্মিত হেসে ভাবলেন, তাদের দিনগুলো যদি আবার ফেরত আসত! যখন বরফ-পানি খেলতে পছন্দ করত সবাই। অথবা বাড়ির উঠোনে কানামাছি ভোঁ ভোঁ…। এই ৪০ ইঞ্চির পর্দার ফুটবলের গেমে মগ্ন হওয়ার চেয়ে তার ছেলেও যদি মাঠে বল নিয়ে দৌড় দিতে চাইত… সুন্দর স্বাস্থ্য, প্রশান্ত মনের দিনগুলো হয়তো মানসিক চাপ ও আসক্তির দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসে।

‘শহরের ছেলেমেয়েদের

স্মার্টফোন আসক্তি বেশি’

—মারুফ হাসান

শিক্ষার্থী, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা তো কিছুই করে না। আমাদের সময় তো কত মজা করতাম। মাঠে ফুটবল, কাবাডি, হাডুডু, ক্রিকেট খেলতাম, লুডু খেলতাম, ধনী হওয়ার মজার খেলা খেলতাম। তোরা তো খালি পারিস মোবাইল ফোনের মধ্যে বুঁদ হয়ে ঘরের এক কোণায় গিয়ে গেম খেলতে।’ এই কথাটা পুরোপুরি সত্যি না।

এখনো অনেক গ্রামাঞ্চলের অলিগলিতে ছেলেরা কাঠের টুকরোকে ব্যাট আর ইট দিয়ে স্টাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলে। মনে স্বপ্ন তাদের, মুদি দোকানের টেলিভিশনে দেখা সাকিব আল হাসান আর মাশরাফি হওয়ার। মেয়েরা এখনো এক্কাদোক্কা, লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি আরও কত ধরনের খেলাই খেলে। তারাও হয়তো কৃষ্ণা রানী সরকার হওয়ার স্বপ্ন দেখত যদি পরিমিত পরিমাণে সুযোগ পেত। তবে ঠিক এর উলটো ঘটনা ঘটে যখনই আমরা গ্রাম থেকে শহরের দিকে আসি। শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকায় খেলার মাঠের খুব বেশি অভাব। যে কয়টি আছে তার মধ্যে আবার বেশিরভাগই প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তার ওপর ডিজিটালাইজেশনের কারণে এখন ছোট-বড় সকলের কাছেই আছে মোবাইল ফোন। এজন্য আর তারা মাঠে না গিয়ে বাসায় বসে মোবাইলে কিংবা কম্পিউটারে গেম খেলাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এর ফলে দেখা যায় আমরা যারা ৯০ দশকের ছেলেমেয়েরা যেধরনের মজা করে কানামাছি খেলতাম, সাতচাড়া খেলতাম, লুডু খেলতাম সেগুলো থেকে তারা শতভাগ বঞ্চিত হয়। হয়তো এই অনলাইন গেমগুলো খেলার মাধ্যমে তাদের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে কিন্তু সেটাকে ঠিক সামাজিকীকরণ বলা যায় না, দুটোর মধ্যে বিরাট ফারাক। আরেকটা মানুষের সঙ্গে দেখা করে তার সঙ্গে খেলাধুলা করে যে মজা এবং যেই মেলবন্ধনটা হয়, সেটা অনলাইনে কখনোই হয় না। কিন্তু এর ফলে ছেলেমেয়েরা একটি ছোট দুনিয়ায় আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাঠে ঘাটে বা সশরীরে খেলাধুলা করতে গেলে যেসব ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয় এবং এক ধরনের সামাজিকীকরণ হয়, সেটি আর হচ্ছে না। ফলে এই ছেলেমেয়েগুলোর গায়ে দিন শেষে ‘লাইফলেস’ নামক ট্যাগটি পড়ে যায় এবং বাস্তবের সুখ, হাসি, আনন্দ কোনো কিছু সম্পর্কেই তাদের ধারণা থাকে না।

তারা আনন্দ খোঁজে নেয় ফেসবুকে দেওয়া ছবিতে লাইক আর রেসিং গেমে প্রথম হওয়ার মাঝে। তারা বেঁচে থাকে এক স্বপ্নের দুনিয়ায় এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে একসময় এরাই মানসিক সমস্যায় ভোগে যখনই দেখে মোবাইলটা রেখে দিলে তাদের সঙ্গে কথা বলার আর কেউ থাকে না। আমরা কখনোই এমন জেনারেশন চাইনি। আমরা সবাই চাই তারাও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠুক, দুনিয়ার আসল সুখ শান্তি হাসি আনন্দ তারাও ভোগ করুক।

এ বিভাগের অন্যান্য