শঙ্কায় শতাধিক সাংসদ
টেন্ডার-চাঁদাবাজি, দলের ভেতর কোন্দল তৈরি, গডফাদার ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অভিযোগ আওয়ামী লীগের শতাধিক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। দলীয় ভাবে এসব এমপিদের ব্যাপারে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া চলতি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জেলা নেতাদের বৈঠকেও তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে এসব এমপিদের ব্যাপারে তথ্য জানার চেষ্টা করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ফলে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এসব এমপিরা। কারণ, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বির্তকিতদের মনোনয়ন দেয়া হবে না বলে দলীয় প্রধান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
দলের কেন্দ্রীয় নীতি-নির্ধারকরা জানান, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বির্তকিতদের আসনে শতাধিক নতুন নেতা মনোনয়ন পাবেন। ওইসব আসনে যারা সংসদ সদস্য রয়েছেন, তাদের অনেকের প্রতি এলাকার মানুষের বিভিন্ন কারণে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। এই ক্ষোভ যাদের বিরুদ্ধে বেশি, তাদের বাদ দিয়ে সেখানে নতুন মুখ মনোনয়ন দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে লাভবান হবে দল। কারণ নতুনরা কাজ করে। পাশাপাশি তাদের প্রতি আকর্ষণ থাকে সবার। এই আকর্ষণকে পুঁজি করে সুফল ঘরে তোলা যাবে। পাশাপাশি বিতর্কিতদের শাস্তিও দেওয়া হবে, নতুন মুখ দিয়ে সুফলও পাওয়া যাবে। এই হিসাব-নিকাশও রয়েছে সংসদ সদস্য বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেতারা। এসব ঘটনায় যেসব নেতা, এমপি বা মন্ত্রীরা ইন্ধন যোগাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও ভাবছে দলের হাই কমাণ্ড। এমকি খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও কারও কারও কর্মকান্ডে চটেছেন বলে দলের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সম্পৃক্ততার অভিযোগ গণমাধ্যমে আসা এবং স্থানীয় পর্যায়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক এবং র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর মধ্যে কোন্দল, চট্টগ্রামের দুই শীর্ষ নেতার দ্বন্ধের জেরে ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিও আমলে নিয়েছে দলের হাই কমান্ড। এই ধরনের যেসব ঘটনা দেশব্যাপী ঘটেছে। সেগুলোও স্থানীয় নেতাদের নামে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যাতে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।
দলের একাধিক জেষ্ঠ্য নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত এরকম প্রায় শতাধিক সংসদ সদস্যের প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে একাধিক দশম জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন। নেতৃবৃন্দ জানান, প্রাথমিকভাবে তৃণমুল থেকে করে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর এই তালিকা তৈরির কাজ তদারকি করছেন বিভাগীয় পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা। এছাড়াও দলের সভাপতি নিজস্ব লোক দিয়েও তৃণমুল থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করছেন বলেও তারা জানান।
আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের এক সভায় দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব সংসদ সদস্যদের সর্তক করে দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও কঠিন হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। কিন্তু আগামী নির্বাচনে নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হবে। এবার আমি কারও দায়িত্ব নিতে পারব না। যেই হোন না কেন, জনপ্রিয়তা না থাকলে আমি মনোনয়ন দেব না। আপনারা কে কী করছেন, প্রত্যেকের রিপোর্ট আমার কাছে আছে। ছয় মাস পর পর আমি তথ্য নেই। যার অবস্থা ভালো তাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জনবিচ্ছিন্ন এমপিরা এবার টের পাবেন, মনোনয়ন নেওয়ার সময়। দলীয় এমপিদের পারফরম্যান্সসহ তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা, দলের বিভিন্ন স্তর এবং সভাপতির পক্ষ থেকে এমপিদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান,সাংগঠনিক সম্পাদকদের বলা হয়েছে, অভিযুক্ত এবং বিচ্ছিন্ন এমপিদের সতর্ক করতে। তৃণমূলের ক্ষোভ নিরসনে প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও মনোনয়নে তৃণমূলের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এবারও তৃণমূলের মতামতকে মূল্যায়ন করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গণমাধ্যমকে বলেন, আগামীতে যাছাই-বাছাই করে মনোনয়ন দেওয়া হবে, এটি সত্য। এক্ষেত্রে নতুন মুখও আসবে। যেসব সংসদ সদস্য জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এবং বির্তকিত তাদের ব্যাপারে দলের শীর্ষ পর্যায় একেবারেই কঠোর। বিতর্কিতরা মনোনয়ন পাবেন না। এটি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গডফাদার বনে যাওয়া, জনবিচ্ছিন্ন হওয়া, কোন্দল তৈরি করা, টেন্ডার-চাঁদাবাজিসহ দখলদারিত্বের গুরুতর অভিযোগ ওঠা সংসদ সদস্যদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের জানিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য নতুন মুখ আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। এলাকায় যাদের ইমেজ ভালো, পরিচিতি রয়েছে, শিক্ষিত, মার্জিত ও মানুষের আপদ-বিপদে এগিয়ে আসেন, তাদের ভেতর থেকেই এবার বেশি মনোনয়ন দেওয়া হবে।