সুরক্ষায় নিতে হবে জরুরি পদক্ষেপ নেশার জগতে পথশিশু

সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে বেশি ভয় মাদক নিয়ে। মাদকাসক্ত শিশু-কিশোর-কিশোরীর বিষয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই তাদের। বাধাহীনভাবে মাদক সেবন করছে তারা। ফলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত দেশের জনগোষ্ঠীর এ অংশ অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে ধাবিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্ত পথশিশুদের সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের যদি সঠিকপথে নিয়ে আসা যায়, শৈশবজীবন ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তবেই মাদক থেকে মুক্ত করা যাবে। ঠেকাতে হবে মাদকের সহজলভ্যতাও। এককথায় তাদের সামাজিকীকরণ করতে হবে। পাঁচটি মৌলিক চাহিদা ভোগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। সুষ্ঠু সমাজ গঠনে এসব শিশু-কিশোর বড় ধরনের হুমকি বলেও মন্তব্য করেন তারা।

সংশ্নিষ্ট সূত্রমতে, মহিলা ও শিশুবিষযক মন্ত্রণালয়ের পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের অধীনে মাত্র দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে ঢাকায়, যা পথশিশুর সংখ্যার তুলনায় খুব সামান্য। এর মধ্যে একটি কমলাপুরে, অন্যটি কারওয়ান বাজারে। এ দুটি কেন্দ্রের এনজিও সহযোগী অপরাজেয় বাংলাদেশ। কারওয়ান বাজার কেন্দ্রটির কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। একটি ভবনের ছাদে প্যান্ডেল করে ও দুটি কক্ষে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫০ শিশু-কিশোর যাওয়া-আসা করে। কমলাপুর কেন্দ্রে প্রতিদিন ১২০-১৩০ শিশু-কিশোর-কিশোরী যাওয়া-আসা করে। এর মধ্যে ৭০-৮০ শিশু সেখানে রাত কাটায়। তবে মাদকাসক্ত শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই কেন্দ্র দুটির।

কমলাপুর কেন্দ্রের ইনচার্জ শাহ আলম বলেন, মাদকাসক্ত বিষয়ে আলাদা ব্যবস্থা না থাকলেও এ ধরনের শিশু এলে তাদের কাউন্সেলিং করা হয়।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের পরিচালক ড. আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, এসব শিশু-কিশোর মুক্ত জীবন পছন্দ করে। পথ থেকে তারা আসতে চায় না। যারা আসে, তাদের কাউন্সেলিং করানো হয়। তবে তাদের অনুপ্রাণিত করা চ্যালেঞ্জের। শিশুদের মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে আগে মাদকের সহজলভ্যতা ঠেকাতে হবে। হাতের নাগালে মাদক পাওয়ায় তারা সহজেই তাতে আসক্ত হয়ে পড়ে। তিনি জানান, পথশিশু ও ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের পুনর্বাসন প্রকল্প বড় আকারে সারাদেশে শুরু হতে যাচ্ছে।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, পথশিশুদের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে যেসব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে মনিটর করা হচ্ছে না। এ কারণে এসব কার্যক্রমের সফলতা সেভাবে আসছে না।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, যে বয়সে শিশুর স্কুলে থাকার কথা, জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন লালন করার কথা, সেই বয়সে পথে পথে ঘুরছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে এবং রাষ্ট্রের নানা ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে সব পথশিশু এখন পর্যন্ত যথাযথ জায়গায় নিয়োজিত হয়নি। সব শিশুকে বিদ্যালয়ে নেওয়া যায়নি। এসব কারণে তারা ছন্নছাড়া জীবনের কোনো একটা সময়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্রকে দুটি শ্রেণির দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হয়। একটি হচ্ছে যারা আর কাজ করতে পারে না, অর্থাৎ যারা বয়োজ্যেষ্ঠ। অন্যটি যারা এখনও কাজ করতে সক্ষম নয়, অর্থাৎ যারা শিশু। রাষ্ট্রকে এ দুটি শ্রেণির দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি আরও বহুভাবে চিন্তা করতে হবে।

অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা দরকার, যেখানে পথশিশুরা মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারবে। ঠিকানাহীন জীবনযাপন করায় তাদের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি হওয়ার জায়গা থাকে না। তিনি আরও বলেন, মাদকাসক্ত শিশুদের ভালো করতে হলে এলাকাভিত্তিক শিশু উন্নয়ন ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। বিপথগামী শিশুকে পথ থেকে তুলে এনে স্কুলের আওতায় আনতে হবে। সংশ্নিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সতর্ক হতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক সেবনকারী শিশু-কিশোররা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সামান্যতম চিন্তিত নয়। জীবনটা যেন তাদের কাছে মূল্যহীন। ৬ ও ৭ জুলাই কমলাপুর ও গুলিস্তান এলাকার ৩০ জন শিশু-কিশোরের কাছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা কী- জানতে চাওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে একজনও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নয়। গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের পাশে কথা হয় রিপন ও আলীর সঙ্গে। তাদের বয়স ৯-১০ বছর। তাদের ভাষ্য- পরনে ছেঁড়া পোশাক, গোসল নেই, খাওয়া নেই। তাই ভবিষ্যৎ ভেবে কী হবে। রিপন জানায়, তারা বাবা নেই। মা কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করেন। ফুটপাতে থাকেন। সে তার মায়ের কাছে ঠিকমতো যায় না। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। আলী জানায়, তার বাবা-মা একসময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় থাকতেন। সেখানেই তার জন্ম হয়েছে। কাগজ-ভাঙাড়ি কুড়াতেন তার মা-বাবা। তিন-চার বছর বয়স থেকে সে মা-বাবার খোঁজখবর জানে না।

কমলাপুর রেলস্টেশনের পথশিশু ইমন বলে, নিজেও জানি না, ভবিষ্যতে কী করব। সজীব বলে, এখন খেতেই পাই না। পরের (ভবিষ্যৎ) চিন্তা করে লাভ আছে? হানিফ বলে, ‘আমাগো ভবিষ্যৎ নেই। যেমনে চলে চলুক।’ তানিয়া নামের ১০ বছরের এক শিশু জানায়, সে তার মায়ের সঙ্গে স্টেশনে থাকে। বাবা নেই। কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করে যা আয় হয়, দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে জীবন পার হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, এসব শিশু-কিশোর কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। এরপর মাদক থেকে মুক্ত করতে কাউন্সেলিং করতে হবে। তাদের সঠিক পথে রাখতে হবে, না হলে তারা সুষ্ঠু সমাজ গঠনে হুমকি হয়ে থাকবে।

এ বিভাগের অন্যান্য