সিলেটে নৌকা চালাবেন কে?
সিলেট-১ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবসরে যাচ্ছেন। চার দিন আগে এই ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে শোনা যাচ্ছে যে এই আসনে নৌকার প্রার্থী হবেন কে? এদিকে আবার অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর অনুজ জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আব্দুল মোমেন নির্বাচন করবেন। গত ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার, অর্থ মন্ত্রাণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সিলেট সিটিকর্পোরেশনের নব নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে কাউন্সিলরদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। ২০১৬ সালের শেষের দিকে সিলেটের কবি কাজী নজরুল অডিটরিয়ামে দলের এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী তার বয়স হয়েছে জানিয়ে বলেছিলেন, তিনি আর নির্বাচন করবেন না। ওই অনুষ্ঠানে তিনি তার ছোট ভাই জাতিসংঘে সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. একে মোমেনকে সিলেটবাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেন এবং বলেন, দল চাইলে ড. মোমেন সিলেট-১ আসনে নির্বাচন করবেন। ওইদিন তিনি ড. মোমেনকে সিলেটবাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সহযোগিতা চান। অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ঐসময়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের মাঝে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাঁদের নাম ঘুরেফিরে আসছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন, সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, অর্থমন্ত্রীর ছোট ভাই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।
সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলা নিয়ে সিলেট-১ আসন গঠিত। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই আসন বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। এখান থেকে দলগুলো নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করে। গত ৩০ জানুয়ারি এখান থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সভানেত্রী খালেদা জিয়াও সিলেট সফর করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই আসনে বিজয়ী প্রার্থীর দল সরকার গঠন করে আসছে। এমনকি ১৯৯১ সালে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে শুধু এই আসনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন এবং সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। যে কারণে শাহজালালের পূণ্যভূমিখ্যাত সিলেট থেকে দলগুলো নির্বাচনী প্রচার শুরু করে। এই আসনে জয়ী হতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হেভিওয়েট প্রার্থীও দিয়ে থাকে।
এই আসনে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত দুই বছরে বিভিন্ন সময়ে তিনি নির্বাচনে তাঁর অনাগ্রহের কথা বলে আসছিলেন। আবার কখনো বিষয়টি দলের প্রয়োজনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আগামী নির্বাচনেও শেষ পর্যন্ত তিনি প্রার্থী হবেন, এমনটা ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা দেন, আগামী ডিসেম্বরে অবসরে যাচ্ছেন।
দুই বছর আগ থেকে শোনা যাচ্ছিল অর্থমন্ত্রীর পরে সিলেট-১ আসনে তাঁর ছোটভাই ড. এ কে আবদুল মোমেন প্রার্থী হবেন। জাতিসংঘের দায়িত্ব পালন শেষে দেশে এসে সিলেটে বেশি সময় দিচ্ছেন মোমেন। বলতে গেলে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ছায়ার মতো আছেন তিনি। সরকারি-বেসরকারি সব অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিচ্ছেন। দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সদস্যও হয়েছেন। অর্থমন্ত্রীও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এই আসনে নির্বাচন করার আগ্রহের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সংবাদ সম্মেলন করে ভাইকে নগরবাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সেদিন অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি পরিচয় করিয়ে দিই, হি ইজ মাই ইয়ংগার ব্রাদার। দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। এখন দেশে এসেছে। আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়, দেশের জন্য কাজ করতে চায়।’ এর পর থেকে মোমেন মাঠে আছেন।
এদিকে বেশ আগে থেকে এই আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায়ও বিষয়টি উল্লেখ করেন। এর আগে গত বছর দলের সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতেও তিনি এমন ঘোষণা দেন। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন জানিয়ে মিসবাহ সিরাজ বলেন, ‘৫০ বছর ধরে রাজনীতিতে আছি। এখন জনগণের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সেবা করতে চাই।’
কয়েক মাস ধরে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইনের নাম বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। সিলেট নগরের কাজীটুলার বাসিন্দা ছহুল হোসাইন গত ঈদে বাড়িতে এলে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দীর্ঘ সময় আলাপ হয় তাঁদের। এ সময় নেতাদের কেউ কেউ সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার অনুরোধ জানান। ছহুল প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে সম্মত আছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ কারণে ঘনঘন তিনি সিলেট আসছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তিনি সিলেট এসেছেন। দুই-তিন দিন সিলেট থেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর এক ঘনিষ্ঠজন বলেন, ‘প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে তাঁর কাছে প্রস্তাব আছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি নির্বাচন করবেন বলেই মনে হচ্ছে।’
এদিকে অর্থমন্ত্রীর পরে প্রার্থী হিসেবে সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে এত দিন ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁর প্রার্থিতা চূড়ান্ত। তিনিও একাধিকবার বলেছেন, মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে তিনি দলের সভাপতির কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
সম্প্রতি এই আসনে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তাঁকে প্রার্থী করে চমক দেখাতে পারেন বলে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। তিনি সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের একান্ত সচিব ছিলেন। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। আবুল মাল আবদুল মুহিতের পরে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে সবার আগে ভাবা হচ্ছে বলে দলের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ফরাসউদ্দিন প্রার্থী হবেন কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। তিনি এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি।