বিলুপ্তির পথে হাওরের সুস্বাদু দেশীয় জাতের ধান
হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলার লোকজনের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। হাওরকে কেন্দ্র করে চলে এখানকার মানুষের জীবন জীবিকা। এক সময় হাওরাঞ্চলে প্রচুর পরিমানে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন সুস্বাদু ধানের আবাদ হতো। কম ফলন আর বাজারে দাম না পেয়ে এখন এসব ধান চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন কৃষকরা। অধিক ফলনের আশায় পরিবেশবান্ধব সুস্বাদু জাতের ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তারা।
জেলার হাওরজুড়ে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও খরার কবলে থাকার পরও হাওরের জামিতে চাষাবাদ করে আসছেন কৃষকরা। কিন্তু বিগত ১০-১২ বছরের ব্যবধানে জেলার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় জাতের সুস্বাদু ধান। কৃষকরা জানান, দেশীয় প্রজাতির এসব ধানের সঠিক মূল্য ও চাহিদা না থাকায় তারা জমিতে চাষ করছেন না।
জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, দিরাই, শাল্লা, ছাতক, দোয়রা বাজারসহ ১১টি উপজেলার হাওরগুলোতে কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জাতের ৫৮ রকমের ধান চাষ করতেন। গত ১ যুগের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে স্থানীয় জাতের মধ্যে লাখাই, রাজাসাইল, সোনামুখী, মধুমালতি, স্বর্ণমূয়রী, মধূবিরইন, চিনিগুড়া, ময়নাসাইল, লতাশাইল, পাজম, নাজিশাই, বাইগুন বিচি, ধলাকাচাই, মৌমাইল, গড়িয়া ইত্যাদি জাতের ধান।
আগে গ্রাম বাংলার বাড়ি বাড়ি বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু জাতের ধানের চাল দিয়ে রান্না করা হতো অতিথি আপ্যায়নের জন্য। বিশেষ করে কোন অনুষ্ঠানে, বিয়ে, বনভোজন ইত্যাদিতে। এখন কেবল কিছু এলাকার স্বচ্ছল ও সৌখিন কৃষকরা নিজেদের খাওয়া ও অতিথি আপ্যায়নের জন্য কয়েক প্রকার সুস্বাধু জাতের ধান চাষ করছেন।
তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের কৃষক নুর জামাল জানান, তিনি ২ একর জমিতে ব্রি আর ২৮ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষাবাদ করেছেন। এর উৎপাদন দেশীয় ধানের চেয়ে অনেক বেশি।
তাহিরপুর উপজেলার কৃষক নুরুল হক মিয়া জানান, তিনি কিছু জমিতে দেশীয় লাকাই ধানের চাষাবাদ করেছেন। উৎপাদন কম হলেও এই ধানের চাল খেতে সুস্বাদু।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় জানায়, জেলার আবাদি জমির পরিমান ২লাখ ৭৬হাজার ৪৪৭হেক্টর। এবার ২ লাখ ২১হাজার ৭৫০হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। আর বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ১২লাখ ১৯হাজার ৪১৪মেট্রিক টন ধান। কিন্তু সুস্বাদু ও স্থানীয় জাতের ধানের পরিমান একবারেই সামান্য।
খেলু মিয়া, বাচ্চু মিয়া, সংগ্রামসহ জেলার কৃষকরা বলেন, হাওরাঞ্চলের দেশীয় জাতের ধানের তৈরি পিঠা পায়েস, চিড়া, খই মুড়ির বেশ কদর ছিল এখনও আছে। তবে দেশি জাতের সেই ধানগুলোই আর নেই। যদি সরকার ও কৃষি বিভাগ এসব ধান চাষাবাদ ও সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয় তাহলে এসব ধানের কোন পরিচয় থাকবে না।
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস ছালাম জানান, বেশি ফলনের আশায় কৃষকরা হাইব্রিড জাতের ধানের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। আমাদের দেশীয় জাতের ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে হাওরাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু জাতের ধান।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, প্রয়োজনীয় উদ্দ্যোগের মাধ্যমে আবহমান বাংলার কৃষকদের স্থানীয় জাতের ধান চাষে আগ্রহী করে তুলতে ও সুস্বাদু জাতের ধান রক্ষায় প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।