নবযাত্রার স্বপ্ন
‘নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত/আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত/বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে রও, ক্ষমা কর আজিকার মত/পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।’ আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্দা উঠবে নতুন বঙ্গাব্দের। স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নেবে ঘটনাবহুল ১৪২৪। ব্যতিক্রমহীনভাবেই কবিগুরুর গানে আহ্বান জানানো হবে নতুন বছরকে। অনেকটা প্রার্থনাসংগীতের মতোই জরা ও গ্লানির পুরাতন মুছে মঙ্গলময় আগামী নির্মাণের প্রত্যয়ও ঘোষিত হবে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আজ স্বাগত জানানো হবে ১৪২৫ বঙ্গাব্দকে। শুভ বাংলা নববর্ষ, স্বাগত অভিবাদন।
নববর্ষ আসে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যয় নিয়ে। সব অশুভ ও অসুন্দরকে পেছনে ফেলে বৈশাখ আসে নতুনের কেতন উড়িয়ে। বিপুল বৈভব, সম্ভাবনা, নতুনের আহ্বান, পুরাতন দিনের হতাশা কাটিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বাঙালি। পহেলা বৈশাখে আমরা সুন্দর, সুচি আর চিরমঙ্গলের জয়গান করি। স্নাত হই বৈশাখের রৌদ্র খরতাপে, দূর করি বৎসরের যত আবর্জনা। গ্লানি মুছিয়ে, জরা ঘুচিয়ে শপথ নিই বিশুদ্ধতার। নতুন বছরে সবার আশা এক বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। যেখানে থাকবে না কোনো ভয়, হতাশা কিংবা অশুভ শক্তির। গণমানুষের অধিকার আদায় আর শান্তি-স্বস্তির স্মারক হয়ে উঠুক আজ। হাজার বছরের বয়ে চলা লোকজ সংস্কৃতি আমাদের নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। নতুন বছরের নতুন সূর্যোদয়ে নতুন কুঁড়ির মতো আমাদের সমাজ, জীবনে এবং রাষ্ট্রে সম্ভাবনার নতুন নতুন পালক যুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা গণমানুষের। বিশ্বকবির ভাষায়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’
পয়লা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসবের সার্বজনীনতা অসাধারণ। বাঙালি জাতি তার নববর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে, আর এ ধারা চলে আসছে গানে-কবিতায়, লোকাচারের নানা অনুষঙ্গে, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। দেশের বৃহত্তম অসামপ্রদায়িক উৎসব হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ বহুকাল ধরে বরণীয়। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের সঙ্গে বাংলার সাহিত্য, বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই বাংলা সন গণনার শুরু মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন ভিত্তি করে প্রবর্তন হয় নতুন এই বাংলা সন। পরে যুক্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। অমর্ত্য সেন তার আর্গুমেন্টিভ ইন্ডিয়ানে বলেছেন, ‘আকবর সব ধর্মবিশ্বাসীর সমান উপযোগী একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে চেয়েছিলেন।’ আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল আকবরনামায় লিখেছেন, ‘ফসল সংগৃহীত হয় সৌর বর্ষপঞ্জি অনুসারে। তাই হিজরি সালের পাশাপাশি একটি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রয়োজন ছিল। দ্বীন-এ-ইলাহির মতো আকবর সেটির নাম দিয়েছিলেন তারিখ-ই-ইলাহি। বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ সালে। মাসের নামগুলো নেয়া হয় নক্ষত্রের নাম থেকে। তারিখ-ই-ইলাহি চালুর পর ১৪টি নতুন উৎসবের কথা ঘোষণা করেন আকবর। এই রকম এক নওরোজেই শাহজাদা খুররমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মমতাজের। এ কারণে অনেকে বলতে চান, পহেলা বৈশাখ না হলে সৃষ্টি হতো না প্রেমের অমর স্মৃতি তাজমহল।
বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। পয়লা বৈশাখ এখন সব বাঙালির সার্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সমপ্রদায়নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব। কৃষকসমাজ আজও অনুসরণ করছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও পরে সংযোগ ঘটে রাজনৈতিক ইতিহাসের। আমাদের পরাধীনতার কালে এই উৎসব আয়োজনে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাঙালিও সোচ্চার ছিল প্রতিবাদে। ষাটের দশকে রমনা বটমূলে সূচিত ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির আত্মপরিচয়ের আন্দোলন-সংগ্রামকে করেছে বেগবান। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসামপ্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্ব্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে দিয়েছে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা। প্রথমদিকে পয়লা বৈশাখের উৎসব ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। শহরে-বন্দরেও তা সীমিত ছিল হালখাতায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বর্ণিল, বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ উৎসব পালিত হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি নগর-মহানগরে। ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আদলে প্রায় সর্বত্র আয়োজিত হয় এ অনুষ্ঠান। বাংলা নববর্ষে ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ রীতি এখনো এ দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির আমেজ নিয়ে উৎসবের পরিধির বিস্তার ঘটিয়েছে। আধুনিক বাঙালি তাদের বাংলা নববর্ষকে সাজিয়ে তুলছে মাতৃভূমির প্রতিটি আঙিনায় আরো বেশি উজ্জ্বলতায়। দেশের পথেঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসবমুখরতার বিহ্বলতা। পয়লা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ। বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। সর্বত্র দেখা যায় নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। কবির ভাষায়- ‘অনাগত আগামীর অফুরান বাদ্য/নতুনের আবাহনে হয় প্রতিপাদ্য ’।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী ১১টি জাতিসত্তার মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা এবং তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি বছরের হিসাব করে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী। নববর্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধান উৎসব বৈসাবি। ত্রিপুরা জনজাতির বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাইং, চাকমাদের বিজু মিলিয়ে এ বৈসাবি। বাংলা নববর্ষকে উপলক্ষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বাংলা ভাষাভাষি মুসলমান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থানে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাহাড়ি জনপদে এখন উৎসবের অনিন্দ্য আমেজ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিও মেতে উঠবে বর্ষবরণের নানা আয়োজনে। নববর্ষে উৎসব-পার্বণে ভোজনপ্রিয় বাঙালির খাদ্যতালিকায় রসগোল্লা, নকশিপিঠা, কদমা-বাতাসা, ভর্তা, আচার, খই, মুড়ি-মুড়কি, পায়েস অনিবার্য। পালা-পার্বণ, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় উৎসবে এসব সুস্বাদু খাবার শত বছর ধরে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। নববর্ষ উপলক্ষে চারদিকে ধুম পড়বে বাঙালির বাংলা খাবার আস্বাদনে।
নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানিয়েছেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিশ্বের বাঙালিদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন।
নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র বের করবে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হবে। বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা চাদরে। কেবল রাজধানী ঢাকাই নয় এ উপলক্ষে সারাদেশেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করছে সব সংস্থা। সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোস্ট ও চেক পোস্ট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।
বর্ষ আবাহনে মূল অনুষ্ঠান: বর্ষবরণে রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন সংগঠনের নানা আয়োজন থাকবে। দিনের প্রথম প্রভাতেই রমনার বটমূলের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘ছায়ানট’ ভোরের সূর্যের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সরোদবাদন দিয়ে শুরু করবে বর্ষবরণের মূল অনুষ্ঠান। বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপন ১৪২৫ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’- প্রতিপাদ্য ও মর্মবাণী ধারণ করে অনুষ্ঠিত হবে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দুই বছর বিরতি দিয়ে এবার বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে পহেলা বৈশাখে। বাংলা একাডেমি সকালে সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দিবসটি উপলক্ষে বইমেলাসহ বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে একাডেমি চত্বরে। বর্ষবরণ উপলক্ষে চ্যানেল আই ও সুরের ধারা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে আয়োজন করেছে হাজারো কণ্ঠে’ বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। বিকাল তিনটায় নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সকাল নয়টায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বর্ষবরণে তাদের সদস্য ও পরিবারবর্গের জন্য সকাল থেকেই খৈ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা ও বাঙালি খাবারের আয়োজন রেখেছে।