প্রয়াত জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ‘দারুচিনি দীপ’ সিনেমাটা দেখেছিলাম শৈশবেই। স্বপ্নিল সেই দ্বীপে যাওয়ার স্বপ্ন তখন থেকেই। পড়াশোনার ব্যস্ততায় দ্বীপ দর্শনের ফুরসত হয় না যেন! দেখতে দেখতে অনার্স চতুর্থ বর্ষের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। এবার স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে চায়। আর তাই বোধ হয়, দড়জায় উপস্থিত মনোমুগ্ধকর একটি ট্যুরের মাহেন্দ্রক্ষণ।

মনের ভেতর এতদিন পুষে রাখা আকাঙ্খা মুঠোয় ভরে উড়িয়ে দেবার পালা। তার আগে ট্যুরের আবেদন জমা দেওয়া, মিটিং করা, তারিখ নির্ধারণ, কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার কারণে তারিখ পরিবর্তন হওয়া সব মিলিয়ে এক মাস আগে থেকেই ভীষণ এক উত্তেজনা কাজ করছে।

সন্ধ্যা হলেই নিয়ম করে বসেছি ট্যুরের আলাপে। এ যেন এক মহাকর্মযজ্ঞ। সবার সহযোগিতায় প্রস্তুতি শেষ করে একদিন ঠিকই উপস্থিত হলাম শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের গণিত সেমিনারে। সময়টা গেল বছরের ১১ ডিসেম্বর। ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ৭টা। ৩৫ জন সহপাঠী উপস্থিত সেখানে। প্রত্যেকের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। প্রথমেই দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিলেন আমাদের সবার প্রিয় বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক কাশেম আকন্দ স্যার।

ট্যুর কমিটির জিয়া স্যার, মোশাররফ স্যার ও মতিউর স্যারের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। অকৃত্রিম সুন্দর ওই মুহূর্তটি কেউ ক্যামেরার বিরতিহীন ক্লিক বা ভিডিওতে ধরে রাখল। ময়মনসিংহ থেকে দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা বাস ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে আমরা পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য রাঙ্গামাটিতে। সেখানে কাপ্তাই লেক, ঝুলন্ত ব্রিজ আর রাজ বিহারে সারা দিন সময় কাটিয়ে ছুটলাম বান্দরবানের পানে।

পরদিন আবার ভোরে উঠে রওনা হতে হলো নীলগিরির উদ্দেশে। প্রত্যাশিত চান্দের গাড়িতে সওয়ার হয়ে আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু রাস্তায় কুয়াশার মাঝখান দিয়ে যেভাবে যাচ্ছিল, প্রথমে বেশ ভয়ই পাচ্ছিলাম। পরে অবশ্য ভয়টা কেটে গেল। গাড়িতে দাঁড়িয়ে সবাই গলাছেড়ে গাইছে পছন্দের গান। আমরা চলছি, মেঘের মাঝখান দিয়ে। হঠাৎ সূর্যিমামা হাতছানি দিলো। আনন্দ-হৈ-হুল্লাড় আর হর্ষধ্বনিতে কাঁপিয়ে দিলাম মুহূর্তটি। সূর্যিমামার ভেল্কিবাজি আমাদের উচ্ছ্বাস-উদ্বেলে বিভোর করে তুলল সময়টিকে। ঘণ্টা দুয়েক চান্দের গাড়িতে বসে উপভোগ করলাম সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি খেলা।

আকাশের মেঘ ছুঁতে কার না মন চায়! মর্ত্যের মানুষের কাছে এ ইচ্ছে স্বপ্নের মতো। তবে স্বপ্নও কখনো কখনো সত্যি হয়! নীলগিরিতে স্বপ্ন এসে ধরা দিল নিমিষেই। নীলগিরির চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হবে, কোনো এক নতুন সাম্রাজ্যে আমি হাজির হয়েছি। এ সাম্রাজ্যের অধিপতি আমরা সবাই। নীলগিরির চারপাশটা পাহাড়বেষ্টিত। অকৃপণ হাতে প্রকৃতি যেন তার সবটুকু রূপ ঢেলে দিয়েছে এখানে।

কক্সবাজার
দলটি যখন নীলগিরিতে। ছবি: লেখক 

স্যাররা ডাকছেন। সময় শেষ, ছুটতে হবে নীলাচলের দিকে। রওনা হলাম নীলাচলের পথে, পথিমধ্যে চিম্বুক পাহাড়টাও ঘুরে দেখলাম। আবারও সেই সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে আঁকাবাঁকা রাস্তায় আমরা পৌঁছলাম নীলাচলে। নীলাচলের সৌন্দর্য অনেক বেশি। এখান থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় আরও ভালোভাবে। বিকেলে স্বর্ণ মন্দিরটাও ঘুরে এলাম।

এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলো। হোটেল থেকে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে যাত্রা শুরু করলাম কক্সবাজারের পথে। সারা দিনের সব ক্লান্তি যেন ভর করছিল সবার চোখে-মুখে। ঘুম থেকে উঠে দেখি কক্সবাজারের কাছাকাছিই চলে এসেছি।

হোটেলে উঠার পর যেন তর সইছিল না। বন্ধুরা মিলে চলে গেলাম সুগন্ধা বীচে। রাত তখন ২টা। এতদিন টিভিস্ত্রিনেই দেখেছি সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ। আর তখন বাস্তবে দেখার জন্য এগোচ্ছি। দূর থেকে শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কাছে যাওয়ার সাথেসাথেই ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিলো। এ এক মধুর অনুভূতি। এদিকে প্রথমবারের বিশাল ঢেউ দেখে বন্ধু রক্সি উল্টো দিকে দিলো এক দৌড়। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো যে ঢেউ তাকে নিয়ে যাবে না…!

হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৪টা। বিছানায় শুয়ে চোখটা একটু বন্ধ করতেই পরক্ষণে কলিংবেল। টেকনাফের উদ্দেশে আমাদের বাস ছাড়বে সকাল ৬টায়। কেননা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে জাহাজ ছেড়ে যাবে সকাল সাড়ে ৯টায়।

টেকনাফের কিরুনতলী জাহাজঘাটে সময়মতো পৌঁছে গেলাম। নাফনদীতে জাহাজ চলছে। এক পাশে পাড় ঘেঁষে সবুজে বর্ণিল উঁচু উঁচু পাহাড়। নদী পেরিয়ে সাগর। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন সবটুকু পথ জাহাজের রেলিং ধরে মানুষের সঙ্গে পাখিদের মিতালী আর ঢেউ দেখতে দেখতে চলে এসেছি।

পৌঁছে গেছি স্বপ্নের দ্বীপ-কল্পনার দ্বীপ দারুচিনি দ্বীপে। হোটেলে দেরি না করেই সমুদ্র-স্নানে সবাই মিলে নীল পানিতে নেমে পড়লাম। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পানিতেই ঝাপাঝাপি। তার পর গোধূলি বেলায় দ্বীপের চারদিকে সাইকেল ভ্রমণ।

রাতে সমুদ্রের সেই গর্জন মনকে উদাসীন করে দিচ্ছিল। ঠান্ডা বাতাস, সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র, বসে আছি বালির উপর। যতবারই দেখি বুকের ভেতরটা ভরে ওঠে। গর্জন করে ঢেউ আসছে সাদা ফেনা নিয়ে, চলে যাচ্ছে- আবার আসছে। চেয়ে থাকি অবাক হয়ে, কি ক্ষুদ্র আমরা; এ বিশালতার কাছে আমাদের সব কিছুই কত তুচ্ছ!

কক্সবাজার
সমুদ্র সৈকতে সাইকেল চালানো। ছবি: লেখক

এদিকে রাতের বার-বি-কিউ পার্টিটাও কিন্তু জম্পেশ ছিল। পরদিন সকালে ট্রলারে করে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়া হলো। সেখানের কেয়া বন, স্বচ্ছ পানি, মাছের ঝাঁক সবকিছুই মনোমুগ্ধকর।

ওহ, একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছিলাম! স্যাররা কিন্তু এই দিনগুলিতে আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের তারুণ্যময় জিয়া স্যারের এক ফেসবুক স্ট্যাটাস না বললেই নয়। একটি ছবি আপলোড করে তিনি লিখেছেন- ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার বয়স এখন বাইশ, অতএব কোনো কমেন্ট নাই…আমি সেন্টমার্টিনে তাই।’

সময় হয়ে গেছে ফিরতি জাহাজের। কিন্তু ফিরতে ইচ্ছা করছিল না। মন খারাপ নিয়ে ফিরলাম ফের কক্সবাজারে। পরদিন সকালে আমাদের যাত্রা কক্সবাজারের হিমছড়ি। হিমছড়িতে রয়েছে পাহাড়, সমুদ্র ও ঝর্ণার অপূর্ব মিলনমেলা। যা আমাদের বিমোহিত করেছে। সিঁড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠে অবলোকন করেছি সাগর, পাহাড় ও কক্সবাজারের দৃষ্টিনন্দন নৈসর্গিক সৌন্দর্য।

আগে-পরে মিলিয়ে কক্সবাজারে আমরা সাকুল্যে তিন রাত কাটিয়েছি। দিনের হিসেবে দুইদিন। এ স্বল্প সময়েই কত আবেগ, স্মৃতি আর প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডা আর গল্প। সব বলে, লিখে শেষ করা যায় না। শুধু যেন প্রকাশ করা যায় হৃদয়কোণের অস্থির ভালবাসার অনুভূতিটুকু!

যতদিন বুকভরে নিঃশ্বাস নেব, আমার হৃদয় অঙ্গনে রূপময় থাকবে ফেলে আসা এ দিনগুলো। মনে হতেই হয়তো চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়বে আনন্দাশ্রু। তবুও সময়ে-অসময়ে আমি ফিরে যাব, হারানো সেই সোনালি সময়ে। রোমন্থন করব টুকরো টুকরো স্মৃতি।