চলন্ত ট্রেনে আগুন, প্রাণ গেল চারজনের
বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, যশোরের বেনাপোল থেকে ট্রেনটি ঢাকায় আসছিল। সায়েদাবাদ এলাকা অতিক্রম করার সময় ওই ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছার কিছুক্ষণ আগে গোপীবাগ এলাকায় থামানো হয়। আগুনে ট্রেনটির তিনটি কোচ পুড়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ৯টা ৫ মিনিটে খবর পেয়ে তাদের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। তারা ১০টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত পৌনে ১১টায় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন জানান, আগুনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
এ নিয়ে গত ২৮ অক্টোবরের পর ট্রেনে আগুন ও নাশকতার ঘটনায় মোট ৯ জনের মৃত্যু হলো।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি বেনাপোল থেকে বেলা দেড়টায় ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। এটি রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছানোর কথা। তবে পথে ২৫ মিনিট দেরি হয়। ট্রেনটিতে যাত্রী কত ছিল, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি রেলের কর্মকর্তারা।
গোপীবাগের বাসিন্দা রাসেল হোসেন বলেন, রেললাইনের কাছেই তাঁর বাসা। রাত নয়টার দিকে হঠাৎ মানুষের চিৎকার শুনে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে দেখেন, ট্রেনটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অনেকে তাড়াহুড়া করে ট্রেন থেকে নামছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় অনেকে উদ্ধারকাজে এগিয়ে আসেন। তিনিও উদ্ধারকাজে যোগ দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ট্রেনের ভেতরে যখন আগুন জ্বলছিল, তখন কেউ কেউ জানালা দিয়ে তাঁদের বের করার জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু উত্তাপ এত বেশি ছিল যে ট্রেনের কাছে কেউ যেতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে পানি ছিটানো শুরু করে। আগুনে দ্বগ্ধ অথবা নামতে গিয়ে
আহত যাত্রীদের আশপাশের হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়।
প্রথম আলোর মেডিকেল সংবাদদাতা জানান, রাতে আসিফ মো. খান (৩০), কৌশিক বিশ্বাস (৩২), অমিত দেবনাথ (২৭) ও নাসিফ আলম (২২) নামের চারজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আসিফ বলেন, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ট্রেনটিতে ওঠেন। আগুন লাগার পর তিনি জানালা দিয়ে কোনোরকমে মাথা বের করেন। তখন স্থানীয় লোকজন তাঁকে টেনে বের করেন। তাঁর শরীরের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। তিনি দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী নাতাশাকে বের করা সম্ভব হয়নি। যে চারটি লাশ উদ্ধার হয়েছে, তার একটি তাঁর স্ত্রীর হতে পারে।
বেনাপোল এক্সপ্রেসে ঢাকা আসছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনের ‘জ’ কোচে তিনি ছিলেন। সেই কোচের শৌচাগারের ছিটকিনি নষ্ট থাকায় সেটা ব্যবহার করতে না পেরে সামনের ‘ছ’ কোচে যান। হঠাৎ করেই সামনের ‘চ’ এসি (শীতাতপনিয়ন্ত্রিত) কোচে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখেন তিনি। পরে তিনি ট্রেন থেকে দ্রুত লাফিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, তাঁর কোচের যাত্রীদের অনেকে আসন ছেড়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আগুন লাগার পর ট্রেনটি থামানো হয় গোপীবাগ রেলগেট থেকে একটু দূরে। রাত পৌনে ১০টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনের কোচে তখনো আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর কাজ করছেন। আগুনের খবর পেয়ে ট্রেনের যাত্রীদের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে ভিড় করেন। স্বজনকে খুঁজে না পেয়ে কাউকে কাউকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। সেখানে ভিড় করছিলেন স্থানীয় জনতাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। রাত ১০টার পর ট্রেন থেকে পুড়ে অঙ্গার হওয়া চারটি লাশ নামিয়ে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একে একে লাশ বের করার সময় উদ্বিগ্ন স্বজনেরা মরদেহ দেখার জন্য ভিড় করছিলেন। লাশগুলো যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানে গিয়ে কেউ কেউ মরদেহকে নিজের স্বজন বলে দাবি করছিলেন। বেশ কয়েকজন এই প্রতিবেদককে জানান, তাঁদের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন।
গোপীবাগে ট্রেনে আগুনের পর ঘটনাস্থলে যান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ট্রেনে আগুনের ঘটনাটি নাশকতা। এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। যাত্রী বেশে ট্রেনে উঠে কেউ এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।
এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে ট্রেনটির তিনটি কোচ পুরোপুরি পুড়ে যায়। পরে একটি কোচ থেকে মা, শিশুসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকালের ঘটনাসহ গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটি ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া রেললাইন কেটে ফেলার একটি ঘটনা ঘটানো হয়। গতকালের আগে এসব ঘটনায় মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এসব ঘটনার বাইরে রেললাইনে আরও ১৯টি অগ্নিসংযোগ এবং ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
রেলকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনার পর বিভিন্ন পথে আটটি ট্রেনের চলাচল স্থগিত করা হয় এবং দুটি ট্রেনের চলাচল সীমিত করা হয়। রেলপথে নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়। তার মধ্যেই আগুনের এই ঘটনা ঘটল।
রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি সর্বশেষ ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনে যাত্রাবিরতি দিয়েছিল। ৮টা ৫৫ মিনিটের সময় সায়েদাবাদ এলাকা অতিক্রম করার সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা টিজি পার্টি (ট্রেন গার্ড) আগুন লাগার বিষয়টি বুঝতে পারেন। তাঁরাই চেইন টেনে ট্রেন থামান। ঘটনাটি এখন পর্যন্ত নাশকতাই মনে হচ্ছে। ট্রেনটিতে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা নেই।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলীকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল রাত ১১টার কিছু পরে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধারকাজ চলমান। তা শেষ হলে বলা যাবে মোট কতজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রেনটিতে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। আবার বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেও আগুন লাগতে পারে। তদন্তের পর আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
গতকাল রাত পৌনে একটার দিকে দুই নারী, এক শিশুসহ চার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। ঢাকা রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেতাফুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, মরদেহগুলো আপাতত জরুরি বিভাগে রয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সূত্র: প্রথম আলো