অর্থনৈতিক সংকটেও প্রবাস আয়ে স্বস্তি, কমেছে রপ্তানি
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে প্রবাস আয়ে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। তবে রপ্তানি আয়ের চিত্র কিছুটা হতাশাজনক। গত এক বছরে প্রবাস আয় বেড়েছে ২.৮৭ শতাংশ। আর গত ছয় মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ০.৮৪ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮.৫৫ শতাংশ কম।
২০২৩ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন দুই হাজার ১৯২ কোটি ডলার বা ২১.৯২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬৩ কোটি ডলার বেশি। ২০২২ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১.২৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১৩ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। বর্তমানে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে আছেন। প্রবাসী শ্রমিকের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ হলেও প্রবাস আয়ে সপ্তম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছর প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৭৯ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ৩৮ হাজার প্রবাসী দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন।
এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে হারে দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে, সেই হারে রেমিট্যান্স বাড়েনি। কারণ ডলারের দাম বেশি পাওয়া ও পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা।
ডলারের তীব্র সংকটের কারণে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে অনেক ব্যাংকের। এমন পরিস্থিতিতে বছরের শেষ দিকে বেশি দামে রেমিট্যান্স কেনার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে কিছু কিছু ব্যাংক নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দিয়ে প্রবাস আয় থেকে ডলার কিনেছে। যার কারণে বছরের শেষ সময় রেমিট্যান্স-প্রবাহ বেড়েছে। তা না হলে এবারও প্রবাস আয় কম হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলো এখন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দামে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের ডলার কিনছে। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা। তবে কয়েকটি ব্যাংক সংকটের কারণে রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা দরে।
১২ মাসের রেমিট্যান্স
গত বছরের জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স আসে ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ডলার, মার্চে ২০২ কোটি, এপ্রিলে ১৬৮ কোটি, মে মাসে ১৬৯ কোটি, জুনে ২২০ কোটি, জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি, নভেম্বরে ১৯৩ কোটি এবং ডিসেম্বরে ১৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার।
বছরভিত্তিক রেমিট্যান্স
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছিল দুই হাজার ১২৯ কোটি এবং ২০২১ সালে ছিল দুই হাজার ২০৭ কোটি ডলার। ২০২০ সালে রেমিট্যান্স আসে দুই হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে আসে এক হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৮ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে এসেছিল এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০১৬ সালে ছিল এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে এসেছে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। আর ২০১৪ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি ডলার।
ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে
সদ্যঃসমাপ্ত ডিসেম্বরে আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় রপ্তানি আয় ১.০৬ শতাংশ কমেছে। ডিসেম্বরে রপ্তানি হয়েছে ৫৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বিভিন্ন পণ্য, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৫৩৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার। এ নিয়ে টানা গত তিন মাস রপ্তানি কমল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মাসিক রপ্তানি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সংস্থার ওয়েবসাইটে গতকাল হালনাগাদ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
ইপিবির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অক্টোবর থেকে রপ্তানি আয় কমতে শুরু করে। আগের অক্টোবরের চেয়ে ওই মাসে রপ্তানি প্রায় ১৪ শতাংশ কম হয়। নভেম্বরে রপ্তানি কম হয় ৬ শতাংশ। তবে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের ভালো রপ্তানি আয়ের সুবাদে সার্বিক রপ্তানি এখনো নেতিবাচক হয়নি। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ছয় মাসে সার্বিক রপ্তানি বেশি আছে প্রায় ১ শতাংশের মতো। এ সময় রপ্তানি হয় দুই হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের একই সময়ে ছিল দুই হাজার ৭৩১ কোটি ডলার। সার্বিক রপ্তানি এখনো নেতিবাচক ধারায় নেমে না এলেও গত ছয় মাসের রপ্তানি এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৯ শতাংশ কম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করা ছয় মাসের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার ১১ কোটি ডলার।
অর্থবছরের হিসেবে ডিসেম্বরে রপ্তানি কমলেও পঞ্জিকা বছরের হিসাবে ২০২৩ সালের মধ্যে ডিসেম্বরেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হয়। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতেও রপ্তানি মোটামুটি ভালো ছিল। মাসটিতে বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫১৪ কোটি ডলার পণ্য রপ্তানি হয়। এরপর ক্রমেই রপ্তানি কমেছে। বছরের মাঝামাঝিতে এসে জুন মাস ছাড়া আর কোনো মাসেই ৫০০ কোটি ডলারের ঘর স্পর্শ করতে পারেনি রপ্তানি আয়। জুনে রপ্তানি হয় ৫০৩ কোটি ডলারের পণ্য।
প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। বছরটিতে চার হাজার ৭৩৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। আগের বছরের চেয়ে বাড়ল ১৬৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ পোশাক খাতের ওপর ভর করেই পঞ্জিকা বছরে রপ্তানিতে মোটামুটি একটা প্রবৃদ্ধি দেখা গেল। অর্থবছরের হিসাবেও গেল ছয় মাসে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ১.৭২ শতাংশ। মোট দুই হাজার ৩৩৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয় এ সময়। এই আয় লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৮ শতাংশ কম।
রপ্তানি তালিকার বড় পণ্যের মধ্যে হোমটেক্সটাইলের রপ্তানি কম হয়েছে ৩৮ শতাংশ। মোট রপ্তানির পরিমাণ ৩৭ কোটি ডলারের কিছু কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬০ কোটি ডলারেরও বেশি। জানতে চাইলে হোমটেক্সটাইলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জুবায়েরের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, গত বছর গ্যাসের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পর থেকেই হোমটেক্সটাইল রপ্তানিতে দুর্দিন নামে। রপ্তানি মূল্যের চেয়ে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। তাঁর মতো অনেক উদ্যোক্তাই নতুন করে রপ্তানি আদেশ নিচ্ছেন না। আগের রপ্তানি আদেশ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।
বড় পণ্যের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কম হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। রপ্তানি হয় ৪৪ কোটি ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৯ কোটি ডলার। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কম হয়েছে ১৮ শতাংশ। রপ্তানি হয় ৫২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৬৪ কোটি ডলার।
সব ধরনের হিমায়িত ও জীবন্ত মাছের রপ্তানি কম হয়েছে ২ শতাংশ। ২৫ কোটি ডলারের রপ্তানি নেমে এসেছে ২২ কোটিতে। তবে বড় পণ্যের মধ্যে কৃষিপণ্য ও ওষুধের রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ২ শতাংশ হারে। গত অর্থবছরের একই সময়ের ৪৯ কোটি ডলারের রপ্তানি ৫১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ওষুধের রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। ৯ কোটি ডলারের রপ্তানি বেড়ে ১০ কোটি ডলার হয়েছে। ইপিবির তথ্য মতে, রপ্তানি তালিকার ছোট-বড় বেশির ভাগ পণ্যের রপ্তানিই কমেছে গত ছয় মাসে।