ক্ষমতায় বসে দুর্নীতি-হত্যাসহ ১৬ মামলায় দায়মুক্ত হন শেখ হাসিনা

সিলেটের সময় ডেস্ক :

 

পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যা, চাঁদাবাজিসহ ১৬টি মামলা হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে এসব মামলায় শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে কয়েকটি মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে কোনো মামলায় তাঁর বিচার হয়নি।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এতে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসব মামলায় দায়মুক্ত হন শেখ হাসিনা। 

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একই দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গিয়ে নিজের অংশের মামলা একপাক্ষিকভাবে নিষ্পত্তি করলেও খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার হয়নি।

এটি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে স্বাভাবিক বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার এসব মামলা নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল।’ 

হত্যা মামলা : ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ছয় নেতাকর্মীকে লগি-বৈঠা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যার অভিযোগে পল্টন মডেল থানায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

এতে শেখ হাসিনাকে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। ওই বছরের ২২ এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরদিন ২৩ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পরোয়ানা স্থগিত করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৯ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু সাঈদ পল্টন থানায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসককে একটি পত্র দিলে ওই বছরের ১৭ আগস্ট আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন।
চাঁদাবাজির তিন মামলা : ২০০৭ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’-এর পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা করেন ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী। মামলাটিতে অন্য আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও বোন শেখ রেহানা ছিলেন। পরে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ওই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন। ওই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একইভাবে ২০০৭ সালের ১৩ জুন ইউনিক গ্রুপের চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী নূর আলী পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ছাড়া সেই সময় তিন কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী কাজী তাজুল ইসলাম। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়। কাজী তাজুল ইসলাম পরে ট্রাকচাপায় নিহত হন। ওই ব্যবসায়ীকে পরিকল্পিতভাবে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুর্নীতির ১০ মামলা : দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ছয়টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে এসব মামলা হাইকোর্ট থেকে বাতিল করা হয়। এ ছাড়া অন্য চার মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা দুদক। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতির সব মামলায় দায়মুক্ত হন শেখ হাসিনা।

২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে রাষ্ট্রের দুই কোটি ১০ লাখ এক হাজার ৬৮৮ টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন ব্যুরো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল। তদন্ত শেষে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযুক্ত হলেও ২০১০ সালের ৩০ মে এই মামলাটি বাতিল করে দেন হাইকোর্ট।

সরকারি কর্মচারী হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে পারিতোষিক গ্রহণ ও সহায়তার অপরাধে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনাসহ সাতজনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেছিল দুদক। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে ওই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মামলাটি বাতিল করে তাঁদের অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। ২০০২ সালের ৭ আগস্ট দুর্নীতি দমন ব্যুরো ফ্রিগেট কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নৌবাহিনীর জন্য পুরনো যুদ্ধজাহাজ ফ্রিগেট কেনায় সর্বনিম্ন দরদাতা চীনা কম্পানির পরিবর্তে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা দক্ষিণ কোরীয় কম্পানিকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ৪৪৭ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়। তদন্ত শেষে ২০০৩ সালের ৩ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১৮ মে হাইকোর্ট এই মামলাটি বাতিল করেন। অবৈধভাবে মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর মামলা করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। তদন্ত শেষে ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে ২০১০ সালের এপ্রিলে এই দুর্নীতির মামলাটি বাতিল করেন হাইকোর্ট। বিদেশি জ্বালানি কম্পানি নাইকোকে অবৈধভাবে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল দুদক। তদন্ত শেষে শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। পরে ২০১০ সালের ১১ মার্চ মামলাটি বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। নীতিমালা লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করে রাষ্ট্রের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগে ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ওই মামলায় ২০০৮ সালের ২০ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ওই মামলার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার দায়ের করা একটি কোয়াশমেন্ট আবেদন আদালত থেকে খারিজ করে দিয়ে বলা হয়, মামলাটি নিম্ন আদালতে চলবে। প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে সাতজন বিচারপতির ফুল অ্যাপিলেট ডিভিশন এই রায় দেন। ফলে বিশেষ জজ আদালতে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালের ৯ মার্চ ওই দুর্নীতি মামলাটি বাতিল করে দেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে প্রকল্পসংক্রান্ত সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে কাজ দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। ওই প্রকল্পে পরস্পর যোগসাজশে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অধিক ক্ষতিসাধনের আরেক অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ আটজনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। এ ছাড়া ওই প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত না করেই ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে ২০১০ সালের ৪ মার্চ তিনটি মামলাই বাতিল করে দেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের তহবিল থেকে পরিশোধের সিদ্ধান্ত থাকলেও তা না করে সরকারি বিধি উপেক্ষা করে ৪১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ৩ জুলাই মামলা করে দুদক। পরে মামলাটি বাতিল করেন হাইকোর্ট।

আরো দুই মামলা : ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৩(৩) ধারা ও ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩(ক) ধারায় অভিযোগ আনা হয়। পরে তিনি ওই মামলায় অব্যাহতি পান। এ ছাড়া ২০০৩ সালে খাগড়াছড়িতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এতে তিনি মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পান।

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং পরে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। এর মধ্য দিয়ে তাঁর দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনকালের অবসান ঘটে।

এ বিভাগের অন্যান্য