চিনি খেয়েই কোটিপতি ছাত্রলীগের নাজমুল-রাহেল
সিলেটের সময় ডেস্ক :
ছাত্রলীগের পদ যেন ‘পরশ পাথর’ কিংবা ‘আলাদিনের চেরাগ’। অন্তত সিলেট জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজের বেলায় এমনটি মিলে যায়। সাধারণ পরিবার থেকে আসা নাজমুল-রাহেল পদ পেয়ে বছর ঘুরতেই হয়ে যান কোটিপতি। এরপর শুধু বেড়েছে অর্থ।
ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, এলপিজি ফিলিং স্টেশনসহ নানা সম্পদ গড়েছেন। তাদের হাতে সিলেটে চিনি চোরাচালান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছে বলে অভিযোগ। সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, খুন, ধর্ষণ সবই হয়েছে তাদের মদদে। এমসি কলেজের আলোচিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণের হোতাদের আশ্রয়দাতা হিসেবেও অভিযুক্ত নাজমুল। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর তারা পলাতক।
অনুমোদনেই বিতর্কিত জেলা ছাত্রলীগের কমিটি
নাজমুলকে সভাপতি ও রাহেলকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর সিলেট জেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এমসি কলেজে আলোচিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের আশ্রয়দাতা হিসেবে তখন নাজমুলের নাম উঠে আসে। সেসময় কমিটি বাতিলের দাবি উঠে।
কমিটিকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করেন ছাত্রলীগের দুই নেতা জাওয়াদ ইবনে জাহিদ খান ও মুহিবুর রহমান মুহিব। কমিটিকে ঘিরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং টানা কয়েকদিন চলে বিক্ষোভ মিছিল, টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি। ওই সময় কমিটিকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার হোসেন সামাদ বলেছিলেন, ‘ঘোষিত কমিটির সভাপতি এমসির ছাত্রাবাসে তরুণী ধর্ষণের মূলহোতা। আর সাধারণ সম্পাদক ক্লাস ফাইভ পাস করেছে কিনা সন্দেহ। সে অসংখ্য চেক ডিজওনার মামলার আসামি।
মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ধর্ষকদের আশ্রয়দাতা, চোর-বাটপারদের দিয়ে পূণ্যভূমি সিলেটকে কলুষিত করতে জেলা ছাত্রলীগের এ কমিটি দেওয়া হয়েছে।’তাদের হাত ধরেই চিনি চোরাচালান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পায়
প্রায় দুই বছর ধরে সিলেটে চিনি চোরাচালান বিশাল আকার ধারণ করেছে। জেলার সীমান্তবর্তী তিন উপজেলা জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কম্পানীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ভারতীয় চোরাই চিনি অবৈধভাবে দেশে আসছে। কী পরিমাণ চিনি আসে, তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও স্থানীয়দের দাবি, অবৈধপথে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ হাজার বস্তা চিনি আসে। এসব চিনি চোরাচালানের চাঁদাবাজি একসময় নাজমুল ও রাহেল নিয়ন্ত্রণ করতেন।
বিষয়টি প্রথমবার ব্যাপকভাবে জনসমক্ষে আসে ২০২৩ সালের ১১ আগস্ট। চিনি চোরাকারবারি ও অছাত্র দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন প্রসঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে হামলার শিকান হন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আইনজীবী প্রবাল চৌধুরী পূজন। দুদিন পর ১৩ আগস্ট তিনি সিলেট মহানগর হাকিম প্রথম আদালতে জেলা সভাপতি নাজমুল ও সাধারণ সম্পাদক রাহেলসহ ছাত্রলীগের ৫৫ জন নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, ‘অভিযুক্তরা চিনি চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। বাদী ফেসবুকে চিনি চোরাকারবারি ও অছাত্র দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রতিবাদমূলক স্ট্যাটাস দেন। এর জেরেই তাকে প্রাণে মারার উদ্দেশে গুলি করা হয়। এতে তিনি আহত হন।’
তবে হামলা ও চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ সেসময় নাজমুলরা অস্বীকার করেন। এরপর থেকে মূলত চোরাচালানের একক আধিপত্য বিস্তার করে ছাত্রলীগ।
নাজমুলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
চিনি চোরাচালানে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজ ও সন্ত্রাসীদের মদদ, এমসি কলেজ ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তদের আশ্রয় দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ সভাপতি নাজমুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চোরাচালান সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে আসা চিনির ট্রাক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের পাহারায় রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরে ঢুকত। এ কাজের জন্য ট্রাক প্রতি পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা তাদের দিতে হতো। এ খাত থেকে শুধু নাজমুল প্রতিদিন ৭০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পেতেন। রাতভর চোরাচালানের চাঁদার টাকা সকালে তার নাস্তার টেবিলে পৌঁছে দিতে হতো।
২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ক্যাম্পাসের কাছে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে এসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। তাদের জিম্মি করে গাড়িতে তুলে সন্ধ্যার পর কলেজ ছাত্রাবাস এলাকার ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় নারীকে। এ ঘটনায় ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার চার বছর পেরুলেও ধর্ষণকাণ্ডের বিচারকার্য শেষ হয়নি। ধর্ষণে অভিযুক্তরা নাজমুলের অনুসারী এবং তাদের তিনি মদদ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময় অভিযুক্তদের সঙ্গে নাজমুলের বেশ কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে অভিযোগ আরো জোরালো হয়।
বিপুল বিত্তের মালিক নাজমুল ভাইয়েরা
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষক মা-বাবার সন্তান নাজমুলরা সাত ভাই। প্রায় সবাই আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িত। বড়ভাই সৈয়দ আহমদ বহলুল ওসমানী নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি, লোকমান আহমদ রাজনৈতিক পদধারী না হলেও আদম ব্যবসায়ী, শিবলী আহমদ যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ওয়ালি উল্লাহ বদরুল সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় উসমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কামরুল ইসলাম জেলা যুবলীগে অর্থ সম্পাদক, খায়রুল ইসলাম ব্রাজিল প্রবাসী হলেও নাজমুল সভাপতি হলে তিনি দেশে ফিরেন এবং আদমব্যবসা শুরু করেন। নগরে রাণী ট্রেভেলস নামে তার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে।
চিনি চোরাচালানে চাদাবাজি ও আদম ব্যবসা করে নাজমুল ভাইয়েরা প্রচুর বিত্তের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরের ইসলামপুর এলাকায় প্যারাগন প্রপার্টিজে তাদের একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। ভবনের নিচতলার বি-৩ নম্বর ফ্ল্যাটে তাদের পরিবার বসবাস করে। এছাড়া অ্যাপার্টমেন্টের তিন তলায় বি-১১ ফ্ল্যাটও তারা বয়নামা করেছিলেন। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর কেনা হয়নি।
প্যারাগন প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপক ইব্রাহিম আলী বলেন, ‘তাদের একটি ফ্ল্যাট আছে। তবে তা নাজমুলের নামে নয়, পরিবারের নামে। আরেকটি ফ্ল্যাট কেনার কথা ছিল। কিন্তু পরে সেটা আর কেনেননি।’ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ৫ আগষ্ট বিকেল থেকে রাত নয়টার মধ্যে ৫ দফায় নাজমুলের ফ্ল্যাটে হামলা হয়। দফায় দফায় হামলায় বাসার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকেনি।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় চারখাই কনকলস এলাকায় ‘ফারশীদ এলপিজি ফিলিং স্টেশন’ নামে তাদের একটি এলপিজি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল এটির উদ্বোধন করা হয়। নাজমুলের চতুর্থ ভাই উছমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়ালী উল্লাহ বদরুল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিজের ফেসবুকে লাইভ করেন। এ ছাড়া তাদের ব্যবহারের জন্য অন্তত তিনটি দামি গাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বশেষ ৭০ লাখ টাকায় নাজমুলরা আরেকটি গাড়ি কিনেছিলেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এর বাইরেও নাজমুলের সম্পদ রয়েছে বলে ছাত্রলীগ ও চোরাচালানে জড়িত একাধিক ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন। তাদের দাবি, প্রতি মাসে শুধু চিনি থেকেই কোটির বেশি আয় করেছেন নাজমুল। সেগুলো তিনি কোথায় রেখেছেন জানে না কেউ।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চিনি চোরাচালানের সঙ্গে আমার নূন্যতম সম্পৃক্ততা নেই। ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকার কারণে সবসময় মাঠে সক্রিয় ছিলাম। এতে অনেকে ঈর্ষাণ্বিত হয়ে আমাকে বিতর্কিত ও কলংকিত করার চেষ্টা করেছে।’
ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, এলপিজি ফিলিং ষ্টেশনসহ সম্পদ গড়া বিষয়ে বলেন, ‘আমার বাবা-মা দুইজনই শিক্ষক, সরকারি চাকরি করতেন। আমার চার বোন, তিন ভাই প্রবাসী। সুতরাং এসব সম্পদ গড়ার জন্য আমার চিনি চোরাচালান করতে হবে- এমন কথা নেই।
রাহেল সিরাজের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খানের তেলিহাওয়ার গ্রুপের কর্মী রাহেল সিরাজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হলে গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব তৈরি হয়। হামলার ঘটনাও ঘটে। পরে তিনি সিসিকের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ হন। আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। চিনি চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণে তারও নাম রয়েছে। এ খাত থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি পাড়ামহল্লায় নিজের অনুসারীদের গ্রুপ বিস্তার করেন। তার জন্মদিনে রাস্তার পাশে কেক কেটে উদযাপনে যোগ দেন তৎকালীন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান। এরপর এটিকে রেওয়াজে পরিণত করেন রাহেল। পরবর্তীসময়ে নগরের বিভিন্ন গলিরমুখে বা রাস্তার পাশে টেবিল ফেলে অনুসারীদের জন্মদিনের কেক কাটতেন রাহেল। এতে যানজটসহ নানা বিড়ম্বনা পোহাতেন সাধারণ মানুষকে। তার বিরুদ্ধে চেক ডিজওনারের অসংখ্য মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে রাহেল সিরাজের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি দেশে না থাকায় মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
ডজনের বেশি মামলার আসামি তারা
চিনি চোরাচালনসহ নানা মামলায় আগে থেকেই আসামি ছিলেন নাজমুল ও রাহেল। তবে ৫ আগস্টের পর তাদের বিরুদ্ধে এক ডজন মতো মামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে কিশোরকে অন্ধ করার অভিযোগে সিসিকের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে প্রধান আসামি করে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের অর্ধশত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার ৪ ও ৫ নম্বর আসামি হয়েছেন নাজমুল ও রাহেলকে।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
সুত্র্র: কালের কণ্ঠ