অনিয়মে জড়িত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি

সিলেটের সময় ডেস্ক :

 

সমস্যাগ্রস্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটিতে এমডি হিসেবে তার পুনর্নিয়োগ আটকে দিয়ে অভিযোগের বিষয়ে বিশদ তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে ব্যাংকটিতে আপাতত একজন ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগের জন্য পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, তিনিও এমডির দুর্নীতির সহযোগী হওয়ায় ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকসূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো অভিযোগ থেকে জানা যায়, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এমডি হিসেবে ২০১৪ সালে মোহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ নিয়োগ পান। শুরুতেই তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পারভেজ ইউসুফ। যদিও ২০১৫ সালে তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে সতর্ক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পরও তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি থামেনি। এই কয়েক বছরে শফিক বিন আবদুল্লাহকে পুনর্নিয়োগ দিতে না চাইলেও তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে অনাপত্তি বের করে নেন। গত ১০ বছরে এমডি শফিক বিন আবদুল্লাহ ও পারভেজ ইউসুফ নিয়োগবাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়া ঋণ ও ঘুষের বিনিময়ে ঋণ দেওয়া এবং ঋণখেলাপিদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে টাকা ফেরত না দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেন।

জানা যায়, সুইটস অব বেঙ্গল লিমিটেড, অরণ্য ক্রাফট লিমিটেড, বেঙ্গল এক্সপ্রেস লিমিটেড, তমা স্যাটেলাইট ক্যাবল এবং এরিস্টক্রেট করপোরেশনকে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়া ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন এমডি। এ ছাড়া টঙ্গী টোব্যাকোর জামানত হিসেবে রাখা সম্পত্তি বাজারদরের অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করে বাকি টাকা বিদেশে পাচার করেন। আবার ভাইস প্রেসিডেন্ট পারভেজ ইউসুফ ব্যাংকের বিজনেস হেড থাকাকালে এমডি শফিক বিন আবদুল্লাহ শুভ্র ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৬ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে দেন ৪ কোটি টাকার বিনিময়ে। বর্তমানে শুভ্র টেডার্স ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির টাকা দিয়ে এমডি মালেশিয়ায় বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এমডি শফিক বিন আবদুল্লাহর পুনর্নিয়োগের আবেদন যায় বাংলাদেশ ব্যাংকে। তবে কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আটকে দেন। একই সঙ্গে একজন ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগ দেওয়ার জন্য পর্ষদকে চিঠি দেয়। তার অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে বিশদ তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পর্ষদ অপসারণ করে প্রশাসক বসানোর দাবি তুলেছে। এ বিষয়ে চলতি সপ্তাহে গভর্নর বরাবর আবেদন করা হবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ শফিক বিন আবদুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, আমি পুনর্নিয়োগের অপেক্ষায় আছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো চিঠিতেও পুনর্নিয়োগের বিষয়টি তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা ভিত্তিহীন।

২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি চলতি বছরের শুরু থেকে তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। তাই পুরোদমে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মার্চ শেষে ব্যাংকটির ১ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ৭৬৩ কোটি টাকার বিতরণ করা ঋণের (বিনিয়োগ) ৮৯ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকটির পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক যে, তাদের এমন কোনো সিকিউরিটিজ নেই, যার বিপরীতে অন্য ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারবে। আরও জানা গেছে, ব্যাংকটি ধাপে ধাপে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে আইসিবির বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। কারণ তারল্য সংকটে ব্যাংকটি কার্যত বন্ধ আছে।

আর্থিক সংকট নিরসনে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতবিহীন ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তার আবেদন করেছিল আইসিবি ইসলামি ব্যাংক। তবে দুই সপ্তাহ পর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দায় ছিল। সূত্র জানায়, এমডির আমলে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তার গত ১০ বছরের দায়িত্বকালে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসান হয়েছে ব্যাংকটির। সর্বশেষ ২০২৩ সালে লোকসান হয় ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের রেডজোন তালিকায় রয়েছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। ফ্রোজেন ডিপোজিট হলো- ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানত, যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে রেখেছিল। ব্যাংকটির ফ্রোজেন ডিপোজিট ছিল ২ হাজার কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

ব্যাংকটির উৎপত্তি মূলত ১৯৮৭ সালে, তখন এটি আল-বারাকা ব্যাংক নামে পরিচালিত হতো। ১৯৯৪ সালে এটি ‘সমস্যাযুক্ত ব্যাংকে’ পরিণত হয়। তখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ত্রুটিযুক্ত ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রথা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০০৪ সালে এটি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। তবে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ার পর ২০০৬ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয়। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ৩৪টি মামলাও হয়েছিল।

তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার জন্য ব্যাংকটির প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের আগস্টে ব্যাংকটির অধিকাংশ শেয়ার বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনাকারী সুইস আইসিবি গ্রুপের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেন দুজন দরদাতা। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়।

এ বিভাগের অন্যান্য