সিলেটের ঐতিহাসিক স্থান এখনো পাকিস্তানির নামে!
সিলেটের সময় ডেস্ক :
সিলেটের ঐতিহাসিক গোবিন্দচরণ পার্ক। অধুনা সিলেটের মানুষ যেটিকে হাসান মার্কেট নামে চেনে।
যেখানে জড়িয়ে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার। অথচ ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিচিহ্নটিতে এখনো শোভা পাচ্ছে পাকিস্তানির নাম।
বহুমাত্রিক আবেদনে অনন্য আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। ২১ শে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায়ে সিলেটবাসীর উজ্জ্বল অংশগ্রহণ এখানকার স্বতন্ত্র প্রাণশক্তির পরিচায়ক।
১৮৫৭ সালের বৃটিশবিরোধী সিপাহি বিপ্লবের সময় শ্রীহট্টের এই জায়গাটিতে বৃক্ষপত্র সমৃদ্ধ একটি মাঠ ছিল। ইংরেজরা শ্রীহট্টের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেশমাতৃকার অকুতোভয় বিপ্লবী সিপাহিদের ধরে এনে এখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতো। শ্রীহট্টবাসী নীরবে চোখের জল ফেলত।
১৮৭৫ সালে এখানেই হবিগঞ্জের পৈল গ্রামের বিখ্যাত বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ন্যাশনাল স্কুল, যে প্রতিষ্ঠান শ্রীহট্টের শিক্ষার আলো বিস্তারে ছিল বাতিঘর। বিখ্যাত মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) যাত্রা শুরু এখানেই। আর এই ঐতিহাসিক স্থানটিই হলো শ্রীহট্টের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজারের ভূতপূর্ব গোবিন্দচরণ পার্ক, অধুনা সিলেটবাসী যেটিকে ‘হাসান মার্কেট’নামে চেনে। বর্তমান রাজা জিসি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়া মুরারিচাঁদ কলেজ ১৮৯৭ সালের ১২ জুন মেঘালয়ের ডাউকী ফল্ট ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ছোট ছোট মাচার মতো ঘর তৈরি করে এখানেই পুনরায় শুরু হয়েছিল মুরারিচাঁদ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। পরবর্তীতে কলেজটি বর্তমান টিলাগড়ে স্থানান্তরিত হয় ।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হওয়া এক গণভোটে সিলেট ভারতের আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি হয়। তখনই গুঞ্জন শুরু হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু নিয়ে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও আছে এই গোবিন্দচরণ পার্কের ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৪৮ সালের ৮ই মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রথম জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই পার্কেই। ১৯৫২ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত এখানে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে ।
ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়ে আছে এই গোবিন্দচরণ পার্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শ্রীহট্টে যুক্তফ্রন্ট আয়োজিত সব সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো এই পার্কে ।
লেখক কপিল কল্যাণ চৌধুরী তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮-১৯৬০ সালে সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন পশ্চিম-পাকিস্তানি টি. এম. আলী হাসান নামের পাকিস্তান সার্ভিস কমিশনের এক সরকারি কর্মকর্তা। তখন সিলেটে বেশ কিছু উর্দুভাষী ব্যবসায়ী ছিলেন। ওই ব্যবসায়ীদের লোভের সুযোগে ও নিজের নামকে অমর করে রাখতে বদ্ধ পরিকর টি. এম. আলী হাসান সোনালি ঐতিহ্যের বুক খোদাই করে তারই নামে গড়ে তোলেন ‘হাসান মার্কেট’।
১৯৫৯ সাল থেকে নির্মাণ শুরু হয় হাসান মার্কেটের, ১৯৬৫ সালে প্রায় সোয়া ২শ’ ব্যবসায়ীকে তাদের দোকানকোঠা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল উর্দুভাষী ব্যবসায়ী। স্বাধীনতার পরেও হাসান মার্কেট বাইরের লাইন অর্থাৎ দুর্গা কুমার পাঠশালার বিপরীত দিকের দোকানগুলো ছিল উর্দুভাষী বিহারিদের।
সিলেটের মাটিতে আরবি, উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বিশেষ খ্যাতি থাকলেও মাতৃভাষার প্রশ্নের দাবিতে সিলেটবাসীকে খুঁজে পাওয়া যায় আন্দোলনের প্রথম সারিতেই। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে।
সিলেটের সচেতন কবি-লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছ থেকে ওঠা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়। ক্রমে ক্রমে সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের নিরিবিলি আওতা হতে তৎকালীন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট) সিলেটে ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেটের গোবিন্দ চরণ পার্কের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। সিলেটের সকল আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এখন যেমন কোর্ট পয়েন্ট, রেজিস্টারি মাঠ, তেমনি সেকালে ছিল গোবিন্দ চরণ পার্ক।
লেখক ও গবেষক আবদুল হামিদ মানিক তার ‘সিলেটে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯৪৮ সালের আট মার্চ গোবিন্দ পার্কে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন যৌথভাবে একটি জনসভা আয়োজন করে। ৮ মার্চের ওই সভার সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী। যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। সভা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলা বিরোধী পক্ষ লাঠি নিয়ে হামলা চালিয়ে সভাপতির চেয়ার দখল করে নেয়।
ওই হামলায় মাহমুদ আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক) এবং সিলেট তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা ও সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদ আজাদ (বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী) প্রমুখ আহত হন। এরমধ্যে মারাত্মক আহত হন তরুণ কর্মী মকসুদ আহমদ।
১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানের যানবাহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেটে আসেন। সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন আব্দুস সামাদ আজাদ এবং মহিলা মুসলিম লীগ জেলা শাখার সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মহিলা প্রতিনিধি দল মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানান।
সে বছরই সিলেটের নারীরা পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনের কাছে জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সৈয়দা শাহেরা বানু (আবুল মাল আবদুল মুহিতের মা), সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, সৈয়দা নাজিবুন্নেসা খাতুন, প্রমুখ নারী নেতৃদের স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি দেন।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই এভাবেই সক্রিয় ছিল সিলেটের ভাষা প্রেমীরা। নওবেলাল, আল-ইসলাহ ও সুধীজনদের সাহসী ভূমিকায় বাংলার পক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। যার ফলে ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে খাজা নাজিম উদ্দীনের বক্তব্যের রেশ ধরে সিলেট আবারো ভাষা আন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে।
নবগঠিত সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হন পীর হবিবুর রহমান। সেই কমিটির সদস্যরা হলেন মাহমুদ আলী, আব্দুর রহিম (লালবারী), নূরুর রহমান, সা’দত হোসেন, মনির উদ্দিন (পিপি) সহ অনেকেই। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি গোবিন্দ চরণ পার্কে একাধিক সভা হয়।
ওইদিন রাতে ঢাকার খবর পেয়ে শহরে কান্না ও ক্ষোভের সঙ্গে শোভাযাত্রা বের হয়। জিন্দাবাজারে বর্তমান শুকরিয়া মার্কেটে সাপ্তাহিক নওবেলাল-এর অফিসই ছিল ভাষা আন্দোলন কর্মীদের অফিস। ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ও পরিণত পর্যায়ে সিলেটের অনেক গণ্যমান্য পরিচিত মুখ ছিলেন।
যাদের সার্বিক সহযোগিতা ও কঠোর আন্দোলনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের মায়ের ভাষায়, কথা বলার অধিকার।
বাংলাদেশের বয়সের অর্ধেক সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ব্র্যান্ড বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারপরও আজও ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে একজন পাকিস্তানির স্মৃতিকে ধরে রাখা। দেবপুর মৌজাকে আমরা ইসলামপুর বানাতে পেরেছি, কিন্তু হাসান মার্কেটকে গোবিন্দচরণ মার্কেট নামকরণে বদলাতে ভাবনা নেই কারো।