ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর সাহাবিকে নবীজীর বিস্ময়কর মেহমানদারি
সিলেটের সময় ডেস্ক :
পূর্ববর্তী মনীষীরা প্রতিটি আয়াত ও হাদিস নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে আমাদের জন্য নানা পাথেয় ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। জীবনঘনিষ্ঠ সেসব পাথেয় ও শিক্ষা অনুশীলন করতে পারলে মুমিনজীবন হবে সফল ও সার্থক। আজকের লেখায় একটি হাদিস উল্লেখ করা হলো, যার থেকে মুমিনের জন্য প্রায় ১৫টি বিধান ও শিক্ষা রয়েছে।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
আমি ক্ষুধার তাড়নায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম। আর কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি (ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে) নবী (সা.) ও সাহাবিদের রাস্তায় বসে থাকলাম। আবু বকর (রা.) যাচ্ছিলেন।
আমি কোরআনের একটি আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম এই উদ্দেশ্যে যে তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি কিছু করলেন না। অতঃপর ওমর (রা.) যাচ্ছিলেন।
আমি তাঁকে কোরআনের একটি আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি প্রশ্ন করলাম এ উদ্দেশ্যে যে তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনিও চলে গেলেন। কিছু করলেন না। অতঃপর আবুল কাসিম (সা.) যাচ্ছিলেন।
তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন এবং আমার প্রাণ ও চেহারার অবস্থা কী তিনি তা আঁচ করতে পারলেন। অতঃপর বললেন, হে আবু হির! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল আমি উপস্থিত, তিনি বলেন, তুমি আমার সঙ্গে চলো। এ বলে তিনি চললেন, আমিও তাঁর অনুসরণ করলাম। তিনি ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন এবং আমাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পেয়ালায় কিছু দুধ পেলেন। তিনি বললেন, এ দুধ কোত্থেকে এসেছে? তাঁরা বললেন, এটা আপনাকে অমুক পুরুষ বা অমুক মহিলা হাদিয়া দিয়েছেন। তিনি বললেন, হে আবু হির, আমি বললাম, আমি উপস্থিত হে আল্লাহর রাসুল, তুমি সুফফাবাসীদের কাছে যাও এবং তাদের আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো।
বর্ণনাকারী বলেন, সুফফাবাসীরা ছিলেন ইসলামের মেহমান। তাদের ছিল না কোনো পরিবার, ছিল না কোনো সম্পদ এবং কারো ওপর ভরসা করার মতো তাদের কেউ ছিল না। যখন তাঁর কাছে কোনো সদকা আসত, তখন তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি এর থেকে কিছুই গ্রহণ করতেন না। আর যখন কোনো হাদিয়া আসত, তখন তার কিছু অংশ তাদের দিয়ে দিতেন এবং নিজের জন্য কিছু রাখতেন। এর মধ্যে তাদের শরিক করতেন।
এ আদেশ শুনে আমি নিরাশ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, এই সামান্য দুধ দ্বারা সুফফাবাসীদের কী হবে? এ সামান্য দুধ আমার জন্যই যথেষ্ট হতো। এটা পান করে আমার শরীরে শক্তি আসত। যখন তাঁরা এসে গেলেন, তখন তিনি আমাকে আদেশ দিলেন, আমিই যেন তাঁদেরকে দিই। আর আমার আশা রইল না যে এ দুধ থেকে আমি কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ না মেনে কোনো উপায় নেই। তাই তাঁদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে ডেকে আনলাম। তাঁরা এসে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। তাঁরা এসে আসন গ্রহণ করলেন।
তিনি বললেন, হে আবু হির! আমি বললাম, আমি উপস্থিত হে আল্লাহর রাসুল, তিনি বললেন, তুমি পেয়ালাটি নাও আর তাদেরকে দাও। আমি পেয়ালা নিয়ে একজনকে দিলাম। তিনি তা তৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম। তিনিও তৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমনকি আমি এভাবে দিতে দিতে শেষতক নবী (সা.) পর্যন্ত পৌঁছলাম। তাঁরা সবাই তৃপ্ত হলেন।
তারপর নবী (সা.) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে মৃদু হাসলেন। আর বললেন, হে আবু হির! আমি বললাম, আমি হাজির হে আল্লাহর রাসুল, তিনি বলেন, এখন তো আমি আছি আর তুমি আছ। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি ঠিক বলেছেন। তিনি বললেন, এখন তুমি বসো এবং পান করো। তখন আমি বসে পান করলাম। তিনি বলেন, তুমি আরো পান করো। আমি আরো পান করলাম।
তিনি আমাকে পান করার নির্দেশ দিতেই থাকলেন। এমনকি আমি বললাম যে আর না। যে সত্তা আপনাকে সত্য দ্বিনসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম। আমার পেটে আর জায়গা পাচ্ছি না। তিনি বললেন, তাহলে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাঁকে দিলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে বাকিটুকু পান করলেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৪৫২)
সহিহ বুখারির বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারিতে আল্লামা ইবনে হাজার (রহ.) উল্লিখিত হাদিস থেকে মুমিনের জীবনঘনিষ্ঠ ১৫টি বিধান ও শিক্ষা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে ধারাবাহিক উল্লেখ করা হলো :
(১) বসে পান করা মুস্তাহাব।
(২) মেহমানদের কিছু পান করানোর সময় খাদেম নিজে পরিবেশন না করে পাত্র তাদের হাতে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যে একজনের পান করা শেষ হলে সে তার পাশের সাথিকে পান করতে দেবে, এটা উচিত নয়। কেননা এটা মেহমানকে অসম্মানের শামিল।
(৩) এ ঘটনায় নবীজির বিরাট মুজিজা নিহিত রয়েছে।
(৪) অভাব-অনটনের কথা প্রকাশ করা ও ঘোষণা দেওয়া থেকে তা গোপন রাখা বা এর ইঙ্গিত দেওয়া শ্রেষ্ঠতর।
(৫) রাসুল (সা.)-এর উদারতা ও তাঁর নিজের, তাঁর খাদেমের ও তাঁর পরিবার-পরিজনের স্বার্থ ত্যাগ।
(৬) নবী (সা.)-এর যুগে কিছু সাহাবির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সংকটময়।
(৭) আহলে সুফফার মর্যাদা সুপ্রমাণিত।
(৮) আমন্ত্রিত ব্যক্তি আমন্ত্রণকারীর বাড়িতে এসে বিনা অনুমতিতে যেন প্রবেশ না করে।
(৯) আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) নবী (সা.)-এর সব সময়ের সহযোগী এর প্রমাণ বহন করে।
(১০) বড়রা তাদের খাদেমের উপনাম ধরে ডাকতে পারে।
(১১) কাউকে ডাকার সময় নাম সংক্ষিপ্ত করা যায়। যেমন- আবু হুরায়রাহ (রা.)-কে রাসুল (সা.) ইয়া আবা হির বলে ডাকতেন ।
(১২) নবী (সা.) হাদিয়া বা উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং খেতেন। কিন্তু সাদকা খেতেন না, বরং তা হকদারদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন।
(১৩) আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিতে সম্বোধিত ব্যক্তি ‘লাব্বাইকা’ বলতে পারে।
(১৪) খাদেমকে মালিকের ঘরে প্রবেশকালে অনুমতি নিতে হবে।
(১৫) পরিবেশনকারী শেষে পান করবে আর বাড়ির মালিক তার পরে পান করবে। (ফাতহুল বারি ১১/২৮৮)