ঈর্ষা ও ক্ষোভ মনের শক্তিকে বিনষ্ট করে

সিলেটের সময় ডেস্ক :

 

এক রাজ্যে অদ্ভুত এক পাখির আগমন ঘটে। দারুণ সুন্দর দেখতে। অপূর্ব তার গায়ের পালক, চমৎকার লেজ। কিন্তু অদ্ভুত বলছি একারণে যে পাখিটির ছিলো ২টি ঠোঁট। খাবার গ্রহণের সময় এক এক বার এক এক ঠোঁট খাবার গ্রহণ করে।

একদিন পাখিটি উড়তে উড়তে অনেক দূরে চলে গেল। বিশাল ফলের বাগান। পাকা পাকা ফল। সেদিন একটি ঠোঁট পেটপুরে ফল খেলো। অপূর্ব স্বাদ সেই ফলের। ফেরার সময় সেই ঠোঁটটি অপর ঠোঁটকে বলল, এমন সুস্বাদু ফল আমি জীবনেও খাই নি। এখনো যেন ঠোঁটে স্বাদ লেগে আছে। অপর ঠোঁটটি বলল, তুমি তো আমাকেও কিছুটা দিতে পারতে!

সুস্বাদু ফল খেতে না পেয়ে ঠোঁটটি রাগে, ক্ষোভে, হিংসায় জ্বলে পুড়ে যায়। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, এর বদলা নিতেই হবে। কিছুতেই সে আর ধৈর্য ধরতে পারে না। দিন তার কাটতেই চায় না। কোনো খাবারই খেতে ইচ্ছে করে না! হঠাৎ চোখে পড়লো বিষাক্ত একটি ফল। সুস্বাদু ফল খাওয়া ঠোটটির প্রতিশোধ নিতে, তাকে মেরে ফেলার জন্যে ঠুকরে ঠুকরে বিষাক্ত ফলটিকে খেয়ে ফেলে অপর ঠোঁটটি।

পাখিটির ঠোঁট দুটি হলে কি হবে, দেহ তো ছিলো তাদের একটি। কাজেই পাখির সঙ্গে মৃত্যু হয় ঠোঁট দুটিরও।

আসলে আপনি যার জন্যে গর্ত খুঁড়তে যাবেন সেই গর্তে আপনাকেই পড়তে হবে। আপনি যা করবেন তাই প্রকৃতিতে জমা থাকবে। মানুষের মঙ্গল কামনায় আপনার মঙ্গল নিহিত। আর অমঙ্গল চাইলে আপনার ক্ষতিই আগে হবে।

সাফল্য যদিও এক বিরামহীন যাত্রা, তারপরও আমরা যদি এর কোনো গন্তব্য নির্ধারণ করতে চাই তাহলে দেখবো স্কাই ইজ দি লিমিট। বিস্তীর্ণ আকাশের সীমানায় পৌঁছানোর সুযোগ প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। এই সহজাত মৌলিক অধিকার আমরা নষ্ট করে ফেলি কিছু নেতিবাচক আবেগের কারণে। এই রকম দুটো ক্ষতিকর নেতিবাচক আবেগ-ক্ষোভ ও ঈর্ষা।

প্রবাদ আছে ক্ষোভ হচ্ছে এমন একটা বিষ যা সে নিজে পান করছে কিন্তু প্রত্যাশা করছে প্রতিপক্ষ মারা যাবে। রাগ প্রকাশ না করে পুষে রাখলেই তা ক্ষোভে পরিণত হয়। অর্থাৎ যে রাগ আমরা অন্যের ওপর প্রকাশ করতে পারি না কারণ তিনি আমার চেয়ে শক্তিমান তাই আমাদের মনে জমে থাকে ক্ষোভ হিসেবে। রাগ আমরা তার সাথেই দেখাই যে প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্বল। সাধারণত প্রিয়জন বা খুব কাছের মানুষদের প্রতিই ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি জন্মে।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে যে, ‘ঘেঁষাঘেষি বেশি, তো রেষারেষি বেশি।’

আসলে কাছের মানুষদের প্রতি প্রত্যাশা বেশি এবং আবেগের সম্পর্কটা এর মধ্যে চলে আসে। তাই প্রত্যাশিত আচরণ না পেলে তাদের প্রতি ক্ষোভ বেশি আসে। অপরদিকে ঈর্ষা হচ্ছে- সে পেলো, আমি কেন পেলাম না? বা আমি পাবো, কিন্তু সে যেন না পায়। ঈর্ষার প্রকৃতিটা হচ্ছে সে কাউকে অংশীদার করতে চায় না। ঈর্ষা মানে অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা।

আপনার চেয়ে একজন ব্যক্তি যখন একটু এগিয়ে আছে রেজাল্টের দিক থেকে বা চাকরিতে বা ভালো পাত্রের সাথে তার বিয়ে হয়েছে- এটিই আপনার প্রচণ্ড মর্মবেদনার কারণ। তার কোনো আনন্দের সংবাদ শুনলে আপনার ভেতরে কষ্ট লাগে, তখনই বুঝতে হবে আপনি ঈর্ষায় ভুগছেন।

আর মানুষ শুধু দৈহিক শক্তিতে কাজ করে না, সাফল্যের অন্যতম বড় নিয়ামক হচ্ছে মানসিক শক্তি। এই শক্তিকে যে যত বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে পারবে সে তত এগিয়ে যাবে। মন ভালো থাকলে দেহ ভালো থাকে আর তা যখন খারাপ হয় সারা দেহ খারাপ হয়।

যেমন ধরুন- এক বালতি পানিতে আপনি যদি কয়েক ফোটা নীল রং ফেলে দেন দেখবেন নীল রং সমস্ত পানিতে ছড়িয়ে যাবে। ঠিক তেমনি মনের জমে থাকা ঈর্ষা ও ক্ষোভ আপনার মনের শক্তিকে বিনষ্ট করে ফেলবে। আবার যিনি ক্ষুব্ধ তার কাছে এই ঘটনাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সারাক্ষণ তার মনের ভেতরে চলতে থাকে নেতিবাচক চিন্তার ঝড়, মনে মনে নানা প্রতিশোধ, কল্পনা বা অমঙ্গল কামনা। যে কারণে সে কোনো কাজে মনোসংযোগ করতে পারেন না।

সাফল্যের গোপন রহস্য হচ্ছে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে কাজ করা। ক্ষোভে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট ভাবনায় মন নিবদ্ধ রাখতে পারে না। জীবনে সাফল্য লাভের সহজ পথ হচ্ছে অন্যের হৃদয়কে জয় করে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু ঈর্ষাকারী কখনো অন্যের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে না। যাকে আপনি ঈর্ষা করবেন তার সাথে কখনো আপনি সুসম্পর্ক রক্ষা করতে পারবেন না। হয়তো তাকে আপনি বাস্তবে কিছু বলছেন না, কিন্তু অবচেতন ভাবেই তার সাথে আপনার একটা দূরত্ব তৈরি হবে। আপনার যত কাছের মানুষ হোক, তাকে দেখা মাত্রই আপনার মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।

এছাড়া ক্ষোভ ও ঈর্ষা দুটোই স্রষ্টার অপছন্দনীয় বিষয়। মনের ভেতর এই নেতিবাচক আবেগ থাকলে স্রষ্টার রহমত থেকে বঞ্চিত হবেন। যুগে যুগে মনীষীরা তাই ক্ষোভ ঈর্ষা থেকে মুক্ত থাকার উপদেশ দিয়ে গেছেন।

এই ক্ষোভ-মুক্ত থাকার পথ একটাই, ক্ষমা। আসলে ততবারই একজন মানুষকে ক্ষমা করা উচিত যতবার স্রষ্টার কাছ থেকে আপনি ক্ষমা প্রত্যাশা করেন। মহামানবরা এই ক্ষমা করার মহত্বই দেখিয়েছেন এবং ক্ষোভমুক্ত থেকেছেন। ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে স্রষ্টা ভালোবাসেন।

ক্ষোভের সাথে সাথে আমাদের ঈর্ষা থেকেও মুক্ত হতে হবে। আর ঈর্ষামুক্তির জন্যে যার প্রতি ঈর্ষা অনুভব করছে সবসময় তার জন্যে প্রার্থনা করুন। প্রার্থনা করুন, হে প্রভু তোমার ভাণ্ডারে কোনোকিছুর তো অভাব নেই। তুমি তাকে দিয়েছো; তাকে আরো দাও, সাথে সাথে আমাকেও দাও। তার মঙ্গল কামনা করুন, তার প্রতিটি সাফল্যে নিজের সাফল্যের মতোই খুশি হোন, তাকে অভিনন্দন জানান, আন্তরিকভাবে তার প্রশংসা করুন। আর তারপরও যদি আপনি ঈর্ষান্বিত হন তাহলে নিজেকে শাস্তির ব্যবস্থা করুন, দান করুন। আপনার মস্তিষ্ক সচেতন হয়ে যাবে যে, যদি ঈর্ষা করি তো পকেট ফাঁকা হবে, আর দান আপনার অন্তরকে প্রশান্ত করবে।

কেউ নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতাকে বাড়াতে পারলে অন্যের প্রতি ঈর্ষা থাকে না। কেননা, তখন মানুষের প্রতিযোগী সে নিজেই।

অন্যের দিকে তাকাতে গিয়ে নিজের কি আছে তা-ই আমরা ভুলে যাই। যত নিজের দিকে তাকাবো, তত বিস্মিত হবো। তত দেখবো সফল হবার সব উপকরণ আমারও রয়েছে। এর ফলে কৃতজ্ঞ হওয়া ও প্রশান্ত হওয়া সহজতর হবে।

রোগ নিরাময়ে মনোশক্তি ব্যবহারের প্রবক্তা বিশিষ্ট মার্কিন শল্য চিকিৎসক ডা. বার্নি সিজেল বলেন, “অপ্রীতিকর অনুভূতিসহ আপনার অনুভূতিগুলো পুরোপুরি প্রকাশ করে ফেলা উচিত। প্রকাশিত হলেই আপনার ওপর এগুলোর প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো তখন আপনার মনে কোনো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে না-আপনার মনে কোনো গিঁঠ লাগাতে পারে না।”

তবে সবচেয়ে কার্যকর প্রক্রিয়া হচ্ছে মেডিটেশন। যত মেডিটেশন করবেন তত মনের ময়লা-আবর্জনা দূর করতে পারবেন। সংকীর্ণ স্বার্থপরতা কমতে থাকবে। অপরের মঙ্গল কামনা করতে শিখবেন। মন বড় হবে।

আপনার অন্তরে প্রশান্তি থাকলে কে আপনার সাথে কী আচরণ করলো, অন্যের কী আছে যা আপনার নেই, এসব আপনাকে স্পর্শ করবে না।

সকল নেতিবাচক আবেগের শেকড় উপড়ে ফেলে সাফল্যের বীজ রোপণ করে গড়ে তুলতে পারবেন এক মহিমান্বিত সফল জীবন।

এ বিভাগের অন্যান্য